বলা হয়ে থাকে, ‘পাহাড়, নদী, ধান ক্ষুদে জেলা শেরপুরের প্রাণ’। অর্থাৎ কৃষি ও খাদ্যসমৃদ্ধ ও সীমান্তে গারো পাহাড়বেষ্টিত এ জেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল নদনদী। নান্দ্যনিক নামের নানা ছোটবড় নদনদী প্রবাহের সুবাদে এক সময় ধান, পাট উৎপাদন ও বিক্রয়কে কেন্দ্র করে শেরপুরের যাতায়াত ও যোগাযোগ ছিল নদীপথেই।
ইতিহাস বলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অংশও ছিল শেরপুরের নদী পথ। ফলে হাজারও মানুষের জীবিকার অন্যতম মাধ্যম ছিল এসব নদী। কালের পরিক্রমায় জেলার সেই নদীগুলো আজ অস্তিত্ব সংকটের পথে এবং কোনটা মৃতপ্রায়। নিয়মনীতি উপেক্ষা করে প্রভাবশালীদের কারসাজি আর বাঁধসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে নাব্যতা হারিয়ে বিলীন হয়ে গেছে এ অঞ্চলের অনেক নদী, খাল-বিল। প্রবীণদের কাছে সেই নদীগুলো আজ কেবলই স্মৃতি।
নদীর বুক চিরে এখন চলছে চাষবাস, নির্মাণ করা হয়েছে অবৈধ ঘরবাড়িসহ নানা প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে প্রভাবশালীদের দখলে সংকুচিত, তলদেশ ভরাট ও বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হলেও নাব্যতা ফেরাতে সরকারের খনন কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। খননের নামে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও তা যেন জলেই যাচ্ছে। ফিরছে না জলেভরা ঢেউ তোলা নদী।
ঐতিহাসিক তথ্যমতে, শত বছর আগেও শেরপুরে ১৬টি প্রধান ও ৯টি ক্ষুদ্র নদী ছিল। প্রাচীণ ঐতিহাসিক গ্রন্থে যে ১৬টি প্রধান নদীর নাম উল্লেখিত আছে সেগুলো হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র, মালিঝি, সোমেশ্বরী, মৃগী, নেত্রবতী, মহাঋষি, থলঙ্গ, ভোগবতী, খারুয়া, দর্শা, ভুরাঘাট, বলেশ্বরী, সুতী, মরাখড়িয়া, বৃদ্ধ ভোগবতী ও খড়িয়া। এগুলোর মধ্যে মরা বা আধামরা হয়ে ৮টি নদী এখনও কালের সাক্ষী হয়ে কোন রকম বেঁচে রয়েছে। অন্য ৮টি নদী এখন শুধুই ইতিহাস। যে ৮টি নদী কোন রকমে টিকে রয়েছে তারমধ্যে ব্রহ্মপুত্র, মৃগী, সোমেশ্বরী ও মালিঝি পূর্বের নামেই এখনো পরিচিত। আর যে ৪টি নদীর নাম পরিবর্তন হয়েছে সেগুলো হলো ভোগবতী থেকে ভোগাই, মহাঋষি থেকে মহারশি, থলঙ্গ থেকে চেল্লাখালি এবং নেত্রবতী থেকে নেতাই নদী। অপর দিকে ‘দশানি’ নামে নতুন একটি নদীর সৃষ্টি হয়েছে।
শেরপুরের এক সময়ের বিখ্যাত নেতাই নদী একদা নেতাই খালে রূপান্তরিত হয় পরবর্তীতে তা একেবারেই হারিয়ে যায়। অথচ এ নেতাই নদী শেরপুর পরগনার মধ্যে সর্বোচ্চ ৪৩ মাইল দৈর্ঘের ছিল বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। এ ছাড়া শেরপুর পরগনায় মৃগী নদীর দৈর্ঘ্য ২৯ মাইল, ব্রহ্মপুত্র নদ সাড়ে ১০ মাইল, মালিঝি সাড়ে ৩৫ মাইল, চেল্লাখালি ১২ মাইল,সোমেশ্বর সাড়ে ১৮ মাইল, মহারশি ১৫ মাইল এবং ভোগাই নদী ১৬ মাইল দীর্ঘ ছিলো। আর নকলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সূতি নদীকে ঘিরে বৃটিশে চন্দ্রকোণায় গড়ে উঠেছিল বিশাল বন্দর। আর আজ সেই সূতি নদী এখন প্রভাবশালীদের মৎস খামারে পরিণত হয়েছে। কয়েক বছর আগে নদীটি রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও পরবর্তীতে তা ভেস্তে যায়। হিমালয়ের মানস সরোবর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদটি চীন ও ভারত হয়ে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে সিরাজগঞ্জ হয়ে শেরপুর-জামালপুর সীমারেখায় প্রবাহমান হয়েছে। শেরপুর-জামালপুর অংশের এ ব্রহ্মপুত্র, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ নাম ধারণ করেছে। এ ব্রহ্মপুত্র নদ একসময় শেরপুর-জামালপুর (দুই জেলার সীমান্ত ঘেঁষে) জেলার বিশাল চরাঞ্চলের আর্শিবাদ ছিল।
কালের পরিক্রমায় শেরপুর-জামালপুর দুই জেলায় আজ নদীটি কোন রকম বেঁচে আছে। প্রতিবর্ষায় ব্রহ্মপুত্র অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায় দু’জেলার চরাঞ্চলবাসীর মধ্যে। দু’জেলার দু’অংশেই প্রভাবশালীদের থাবায় নদীটি এরমধ্যে দৈর্ঘ প্রস্থ গভীরতা হারিয়েছে। আর দখলতো চলছে প্রতিনিয়ত। ফলে বর্ষাকালে পুরুষ এ ব্রহ্মপুত্র নদ আগ্রাসী রূপ ধারণ করে চরাঞ্চলকে বন্যায় ভাসিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এক সময়ের খরস্রোতা মৃগী নদীর দুর্দশা। জমিদারঅধ্যুষিত শেরপুর টাউনের প্রান্ত ছুঁয়ে অবস্থান মৃগী নদীর। এ নদীটি ভারতের মেঘালয়ের কর্ণঝোড়া নদী নামে পরিচিত। কর্ণঝোড়া মেঘালয় রাজ্য থেকে বের হয়ে শ্রীবরদী উপজেলার মিরকি বিলে মিলিত হয়েছে। শ্রীবরদীর ভেলুয়া হয়ে মিরকি বিলের সেই নদীটি মৃগী নদীর নাম ধারণ করে শেরপুর পৌরসভা হয়ে নকলা উপজেলার চরঅষ্টধর ইউনিয়নে মূল ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিশে গেছে। কালের পরিক্রমায় স্বচ্ছ টলটলে পানির নদীটি নানা কারণে এখন আধুনিক পৌর শহরের বর্জ্যরে আস্তানায় পরিণত হয়ে দূষণে বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। নদীর পাড়ে কোটি টাকায় নির্মাণ করা হয়েছে শহরের বর্জ্য পরিশোধনের ডাম্পিং। সুপ্রাচীন এ পৌর শহরের উপর বয়ে যাওয়া নদীটি ছিল মানুষের মুক্ত বায়ু সেবনের প্রাকৃতিক এক অনন্য আধার। মানুষজন এক সময় এখানে রোগ সারাতে মুক্ত হাওয়া লাগাতেন ও গোসল করতেন। আজ মৃগীর বড় করুণ হাল। শহরের কয়েকটি সুবিশাল ড্রেন নামিয়ে দেওয়া হয়েছে এই নদীতে। বর্জ্য বিষাক্ততায় বিলিন হয়েছে নদীর সুস্বাদু মিঠা পানির মাছ। গোসলসহ নানা কাজে এ নদীতে নামলেই চর্ম রোগের শিকার হতে হয়। অবস্থা এমন বিষাক্ততার কারণে গরু-বাছুরকে পর্যন্ত গোসল করানো যায় না। পানির দুর্গন্ধে মৃগী এখন নিজেই রোগী।
একদিকে পানি দূষণ, অন্যদিকে দখলে মৃগী এখন ছোট্ট খাল পরিণত হয়েছে। নদীর বুকে চাষাবাদ ছাড়াও প্রতিদিন উঠছে বাড়িঘর। শেরপুর পরগনায় নদীটি ২৯ মাইল দৈর্ঘ ৫০ মিটার প্রস্থ, আর গভীরতা ছিল ৪০ হাত। এখন দৈর্ঘ প্রস্থ সবই খাটো হয়ে গেছে। নদীর উপর দিয়ে হাটলেও হাঁটু ভিজে না- এমন চিত্রের ভগ্নদশা ফুটে আছে। অভিযোগ রয়েছে, শেরপুর-জামালপুরের অনেক রাঘব-বোয়াল কোথাও কোথাও নদী ভরাট করে মেগা প্রকল্প করার প্রস্তুতি নিয়েছেন।
অপরদিকে, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরাপাহাড় থেকে কংস নদীর জন্ম হয়ে শেরপুরের হাতিপাগার এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারতে এর নাম কংস হলেও শেরপুররের নালিতাবাড়ীর হাতিপাগার এসে এ নদীর নাম হয়েছে ভোগাই। নালিতাবাড়ীর ৫ কিলোমিটার ভাটিতে ভোগাই দিংঘানা, চেল্লাখালি, মহারশি, মালিঝি ইত্যাদি বাহারি উপ-নদীর নাম ধারণ করে আবার খরস্রোতা ভোগাই নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এ ভোগাই নদীটি ময়মনসিংহের ফুলপুরের খড়িয়ানদীর সাথে মিশে গেছে। খরিয়া নদীটি আবার ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিশেছে। দীর্ঘদিনের দখল আর নানা উৎপাতে এ নদীগুলো আজ কোনটি বিলীন, কোনটি চেনাই যায় না। অথচ বিশাল পাহাড়ঘেরা ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢলের পানি ধারণ করত এ নদীগুলো। নদী শেষ হলেও মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢল এখন ভোগাই, চেল্লাখালি, সোমেশ্বরী, মহারশির নদীর দুকূলে রৌদ্র মূর্তি ধারণ করে। বর্ষায় প্রতি বছর পাহাড়ি ঢলের সাথে নেমে আসা বালি-পলিতে ভরাট হয়ে পড়েছে নদ-নদীগুলোর আশপাশ। খননের অভাবে জেলার প্রায় সব নদীতেই পানির সংকট। পানি না থাকায় নদীর ওপর দিয়ে হেঁটে চলাচল করে পথচারিরা। তা ছাড়া পাহাড়ি ঢলের সাথে উজান থেকে আসা বালির আস্তর পড়ে ভাটির দিকের শতশত একর ফসলি জমি অনাবাদি হয়ে পড়ছে। অপরদিকে অপরিকল্পিত এবং অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের প্রতিযোগিতা নদীগুলোকে শ্রীহীন করে তুলছে।
শেরপুরের ঐতিহাসিক তথ্যমতে, এ অঞ্চলে একমাত্র ব্রহ্মপুত্র নদ ছাড়া সবগুলো নদীর উৎপত্তিস্থল প্রতিবেশী ভারত। ভারত থেকে গারো পাহাড় হয়ে শেরপুর দিয়ে মিশে গেছে অন্যান্য নদীতে। ১৮৮৫, ১৮৯৭ এবং ১৯১৮ সালে এ অঞ্চলজুড়ে প্রবল ভূমিকম্প হয়। এর ফলে শেরপুরের বেশ কিছু নদ-নদী, খাল-বিলসমূহের গতি পরিবর্তিত ও ভরাট হয়ে যায়। এ ছাড়া গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে গারো পাহাড় এলাকায় নির্বিচারে বনভূমি ধ্বস এবং পাহাড়ি টিলা খুঁড়ে পাথর উত্তোলন শুরু হয়। এর ফলে উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানির সাথে পাথর তোলা আলগা বনভূমির মাটি, বালি-পলিতে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যেতে শুরু করে। আধুনিক নগরের বর্জ্য পলিথিনের জায়গা হয় এসব নদী বক্ষে। তাছাড়া উন্নয়ন ও উৎপাদন বাড়াতে ব্রহ্মপুত্র, মহারশি, সোমেশ্বরী, ভোগাই, চেল্লাখালিনদীর স্থানে স্থানে অপরিকল্পিতবাঁধ, স্লুইস গেট নির্মাণের ফলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে আস্তে আস্তে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে চর পড়ে গেছে। কিন্তু নদী খননের কার্যকর কোন উদ্যোগ-আয়োজন না থাকায় নাব্যতা হারিয়ে নদীগুলো আজ প্রবাহহীন। জেগে ওঠা চর চলে গেছে প্রভাবশালীদের হাতে। নদীর বুকে চলে চাষাবাদ, গড়ে উঠছে বসতবাড়ি। নানা বিবর্তন পরিবর্তন প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক ও জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে নাব্যতা হারানো নদীগুলো এখন পরিণত হয়েছে সামান্য জলাধারে। নদী তার প্রাকৃতিক গতি হারানোর। ফলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণি। এই নদীগুলোকে বাঁচাতে বিভিন্ন সংগঠন একাধিকবার দাবি জনালেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যত কিছুই হয়নি।
বিশিষ্টজনদের দাবি, নদী সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি ও নদী সুরক্ষায় সংগঠিত হওয়া জরুরি। মিলিত উদ্যোগ ও সক্ষমতা আমাদের নদী বাঁচাতে সহায়তা করবে। নদী রক্ষা আইনের মাধ্যমে নদীর পুনঃখদল ও খনন করে নদী প্রকৃতির কাছে ফিরিয়ে দিতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। আর নদী বাচাঁতে না পারলে পরিবেশ দূষণের বিপর্যয় থেকে আমাদের কেউ রক্ষা করতে পারবে না।
এ ব্যাপারে শেরপুর জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান নদীগুলোকে মোটামুটি আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে আশার কথা জানিয়েছেন।
তিনি জানান, জেলা প্রশাসনের তত্বাবধানে গঠিত নদী-খাল দখলমুক্ত কমিটি কাজ করছে। ইতোমধ্যে দখলদারদের তালিকা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলেই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।
নকিবুজ্জামান খান জানান, ৬৪ জেলায় নদী খনন প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের আওতায় এরমধ্যে মালিঝি নদী ও মৃগী নদীর পুনঃখনন কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও কিছু নদী, খালবিল পুনঃখননের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। পরিকল্পনামাফিক খননের কাজ শেষ করতে পারলে দখলমুক্তসহ নদী-খালগুলো পুনরায় আগের রূপ ফিরে পাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ