শেরপুরের গারো পাহাড়ে বন্য হাতির তাণ্ডবে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন পাহাড়ি গ্রামবাসীরা। হাতির কবল থেকে রক্ষা পেতেঘর-বাড়ি ফেলে রেখে অনেকেই চলে আসছেন লোকালয়ে।
জানা যায়, সীমান্তের প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকার বনাঞ্চলে অবস্থান করছে বন্য হাতির দল। হাতি কবলিত ৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৫০টি পাহাড়ি গ্রামগুলোতে গারো, হাজং, কোচ,বানাই, হিন্দু মুসলমানসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রায় ৫০ হাজার লোকের বসবাস। ১৯৯৫ সালে এসব পাহাড়ি গ্রামগুলোতে শুরু হয় বন্যহাতির পদচারণা। হাতির দল দিনে গভীর অরণ্যে আশ্রয় নিচ্ছে। আর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে খাদ্যের সন্ধানে নেমে আসছে লোকালয়ে। ঘর-বাড়ি, ক্ষেতের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে।
ফসল রক্ষার্থে গ্রামবাসীরা রাত জেগে পাহাড়া দিচ্ছে । ঢাকঢোল ও পটকা ফুটিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা চলছে। কিন্ত যতই হাতি তাড়ানোর চেষ্টা চলছে ততই হাতির দল তেড়ে আসছে। হাতির কবল থেকে রক্ষা পেতে ঘর-বাড়ি ফেলে রেখে অনেকেই চলে আসছেন লোকালয়ে। হাতি চলে যাবার পর বাড়ি ফিরছেন তারা। এতে যেন পাল্লা দিয়েই বাড়ছে মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব। নির্ঘুম রাত কাটছে পাহাড়ি গ্রামবাসীদের।
হাতি কবলিত এলাকাগুলোতে নেই ন্যাচারাল বন। এক সময় ২০ হাজার একর বনের জমিতে শাল গজারি বন ছিল। ৯০ দশকের পর থেকে এসব বন পরিস্কার করে সামাজিক বন। শতশত একর জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে। গড়ে উঠেছে জনবসতি। এতে গড়ে উঠছে না হাতির খাদ্য। বনের জমি বেদখল হওয়ায় সংকুচিত হয়ে পড়েছে হাতির আবাস্থল।
জানা গেছে, বন বিভাগের পক্ষ থেকে গারো পাহাড়ে হাতির ২ টি খাদ্য ভান্ডার গড়ে তুলার জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ হয়। কিন্তু ওই খাদ্য ভান্ডার আর আলোর মুখ দেখেনি।
নাওকুচি গ্রামের ইউপি সদস্য গোলাপ হোসেনসহ গ্রামবাসীরা জানান, বন্যহাতির তাণ্ডবে পাহাড়ি এলাকার জমিগুলো চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না। অনেকেই জীবিকার তাগিদে হাতির আক্রমণের ভয় উপেক্ষা করে চাষ করেছেন। এছাড়া পাহাড়ি গ্রামগুলোতে নেই কোন ককর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। ফলে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছেন তারা।
গজনী গ্রামের অবিও সাংমা বলেন, পেটে খাবার না থাকলেও প্রতিরাতেই হাতি তাড়াতে মশালে ব্যবহারের জন্য কমপক্ষে ২ লিটার কেরোসিন তেল ঘরে রাখতে হয়। অনেকের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। হাতির আক্রমণ শুরুর দিকে প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে পাহাড়ি গ্রামবাসীদের মশালে ব্যবহারের জন্য কেরোসিন তেল বিতরণ করা হতো। কিন্তু এখন আর তা করা হয় না। হাতির কবল থেকে পাহাড়ি গ্রামবাসীদের রক্ষার্থে বন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সোলার ফেন্সিং স্থাপন করা হয়। কিন্তু ঠিকাদার নিম্নমানের কাজ করায় তা কোনই কাজে আসছে না। অকেজো হয়ে পড়ে আছে সোলার ফেন্সিং।
৪ ডিসেম্বর বুধবার সকালে অনুসন্ধানে গিয়ে জানা যায়, ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত হাতির আক্রমণে ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত শতাধিক। আর হাতির মৃত্যু হয়েছে ৩৩টি। ৩টি হাতি হত্যার বিষয়ে মামলা হয়েছে। এসব হাতির বেশির ভাগই মৃত্যু হয়েছে বৈদ্যুতিক ফাঁদে, নয়তো ধারালো অস্ত্রের আঘাতে।
হাতির সাথে যুদ্ধ করে বিপর্যস্থ গ্রামবাসীদের খাদ্যসহায়তা ও হাতি তাড়াতে কেরোসিন তেল বিতরণ ব্যবস্থা চালু রাখার দাবি উঠেছে জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে।
শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুরি রেঞ্জ কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, হাতিকবলিত এলাকায় বসবাসকারীদের সরিয়ে নেয়া ও খাদ্যভান্ডার গড়ে তোলা হলে মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব কমিয়ে আনা যাবে।
ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আ.ন.ম. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, হাতির আক্রমণে নিহতদের পারিবার ও ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের ক্ষতিপূরণ বাবদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, সীমান্তের গারো পাহাড়ে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে জনগণকে সচেতনতার লক্ষ্যে বন বিভাগের পক্ষ থেকে রেসপন্স টিম কাজ করছে। এছাড়া সীমান্ত এলাকায় সোলার ফ্যানসিং স্থাপন এবং অভয়ারণ্য গড়ে তোলাসহ টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে আর্থিক সহায়তা প্রদান কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। পাহাড়ে হাতিসহ প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় চেষ্টাও করা হচ্ছে।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ