আধুনিকতার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। উন্নত জীবনের আশায় ইট পাথরের পাকা বাসস্থানের পেছনে ছুটছে মানুষ। এতে করে কালের গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের ধারক মাটির ঘর।
একসময় গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার প্রায় বাড়িতেই দেখা মিলতো মাটির ঘরের। তবে নগর জীবনের ছোঁয়া লেগেছে বাসিন্দাদের ওপর। আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে পাল্লাদিয়ে জীবনমান উন্নয়নে ইট পাথরের বাসস্থান তৈরিতে ব্যস্ত সবাই। মাটির ঘরের জায়গা দখল করে নিয়েছে ইট-পাথরের তৈরি দালান। এতে করে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের মাটির ঘর। আগে প্রতিটি বাড়িতেই মাটির ঘর ছিলো চোখে পড়ার মত । এখন সেসব ঘরের জায়গা দখল করে নিয়েছে দালানকোঠা।
সোমবার (২৮ই অক্টোবর) উপজেলার রতনপুর এলাকায় গিয়ে দেখা মিলে কিছু সংখ্যক মাটির ঘরের। তবে বেশির ভাগ মাটির ঘর গুলো এখন পরিত্যক্ত, বসবাসের উপযুক্ত নেই। আবার কেউ পূর্বপুরুষের সেই স্মৃতি ধরে রাখতে মাটির ঘর রেখে দিয়েছে। আবার কেউ নিজেদের মত করে কোনো রকম বসবাস করছেন। তবে মাটি ঘরের কারিগর না থাকায় মাটির ঘরের পরিচর্যা নিজেরাই করছেন।
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ মাটির ঘরে বসবাস করে আসছে। মাটির সহজলভ্যতা, প্রয়োজনীয় উপকরণ আর শ্রমিক খরচ কম হওয়ায় আগের দিনে মানুষ মাটির ঘর বানাতে বেশ আগ্রহী ছিল। এসব মাটির ঘর তৈরি করতে কারিগরদের সময় লাগতো দুই থেকে তিন মাস। কিন্তু বর্তমানে এর চাহিদা না থাকায় কারিগররাও এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পরেছে।
মাটির ঘর শীতের সময় উষ্ণ, আর গরমের সময় শীতল থাকে। তাই মাটির ঘরকে গরিবের এসিও বলা হয়ে থাকে। কাদামাটি দিয়ে দেড় থেকে দুই ফুট চওড়া করে ৮ থেকে ১০ ফিট উঁচু দেয়াল নির্মাণ করে টিনের ছাউনি দিয়ে মাটির ঘর তৈরি করা হতো। যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান ও উৎসব এলেই কাঁদামাটির প্রলেপের মাধ্যমে গৃহিণীদের হাতের ছোঁয়ায় সেই মাটির ঘরের সৌন্দর্য আরও দ্বিগুণ হয়ে যেত। মাটির ঘরকে ভেতর ও বাইরে থেকে আরও আকর্ষণীয় করতে আল্পনা আঁকাতেন গৃহীনিরা। কেউবা এই মাটির ঘরে সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে আরও মজবুত করে তাতে রং বা চুন লাগিয়ে দৃষ্টি নন্দন করতো। দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় ছিলনা এটি মাটির ঘর না পাকা দালান বাড়ি।
গৃহিণী সাহিদা বেগম বলেন, ৩০ বছর ধরে মাটির ঘরে বসবাস করছি। দুই ছেলেকে পাকা ঘর করে দিয়েছি। আমরা মাটির ঘরেই থাকি। মাটির ঘরে গরমের সময় গরম লাগে না। শীতের সময় শীত লাগে না। মাটি ঘরে থাকা খুবই আরামদায়ক।
রমজান নামে এক ব্যক্তি বলেন, জন্মের পর থেকেই মাটির ঘরেই বড় হয়েছি। এখনো মাটির ঘরেই থাকি। ছেলেদের ইট পাথরে পাকা ঘর তৈরি করে দিয়েছি। ওরা ওখানেই থাকে। আমরা বুড়াবুড়ি যতদিন বাঁচি বাবার ভিটা মাটির ঘরেই থেকে যাব।
আব্দুল লতিফ নামে এক প্রবীণ নয়াশতাব্দীকে বলেন, ছোট বেলা থেকে মাটির ঘরে বড় হয়েছি। এক সময় উপজেলায় মাটির ঘরের অনেক কদর ছিল। মাটির সঙ্গে পানি মিশিয়ে কাদা করে ৩-৪ দিন রেখে আবার সেই মটিতে পানি দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে আঠালো করে তা দিয়ে ২ থেকে ৩ মাসে ঘর প্রস্তুত করা হতো। আগে এখানে প্রতিটি বাড়িতেই মাটির ঘর ছিল। ছোট বেলায় দেখতাম রুচিশীল মানুষরা এই ঘরে বিভিন্ন নকশা করাতো। অনেকে নকশার সাথে সাথে সিমেন্ট বালির প্রলেপ দিয়ে রঙ করাতো। দূর থেকে দেখে অবিকল পাকা ঘরের মতো লাগতো। বুঝাই যেতো না মাটির ঘর না পাকা ঘর। উপজেলায় এখন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে ইট পাথরের বহুতল ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে।
নয়াশতাব্দী/ইএইচ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ