কক্সবাজার আদর্শ মহিলা কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ ফরিদ আহমেদের কার্যকলাপ হার মানায় সিনেমার কাহিনিকেও! ছিলেন সামান্য শিক্ষক; কিন্তু ‘অধ্যক্ষের পদটি’ হাতে পাওয়ার পর বদলে গেছে তার জীবনের সব দৃশ্যপট—বিত্তবৈভব এবং প্রভাবে তিন যুগে অধ্যক্ষ ফরিদ হয়ে উঠেছেন বেপরোয়া-অপ্রতিরোধ্য। নামে-বেনামে গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ, মালিক হয়েছেন বাড়ি ও ফ্ল্যাটের এবং অবশ্যই মাদরাসার টাকা আত্মসাৎসহ, অবৈধ উপায়ে। তিন দশকের বেশি সময়ে ফরিদের মতো আরও অনেক প্রভাবশালী প্রধান শিক্ষক অনৈতিকভাবে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তবে বিস্ময়কর বিষয় হলো, ফরিদের দলীয় কোনো পদে ছিলেন না কখনো। মহিলা মাদরাসাটির প্রধান শিক্ষকের পদ কাজে লাগিয়ে কক্সবাজারে অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন ফরিদ। এমনই দৌরাত্ম্য ছিল তার; এতিমের টাকা আত্মসাতের পাশাপাশি রয়েছে মাদরাসা ও এতিমখানার ছাত্রীদের নিজের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করানোর অভিযোগও।
অভিযোগ উঠেছে, মাদরাসার প্রধান হয়েই নিজের নামে গড়ে তুলেছেন প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদ। আর সেই মাদরাসাকে বানিয়ে ফেলেছেন পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। আর লুটপাট করেছেন মাদরাসার টাকা ও সম্পদ। মাদরাসার সম্পদ ১৩টি দোকানের এক কোটি ২০ লাখ টাকা সেলামি তো মেরে দিয়েছেনই, এখন সেই দোকানগুলোর প্রতি মাসের ভাড়া ১ লাখ ২০ হাজার টাকার একটি টাকাও মাদরাসার অ্যাকাউন্টে জমা করেননি। দীর্ঘ ৩৬ বছর একই পদে বহাল থেকে অবসর নেওয়ার পরও মাদরাসাটিতে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে নিজের আপন মানুষকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে পদায়ন ও মাদরাসা কম্পাউন্ডে ভবন দখল করে বহাল তবিয়তে পরিবার নিয়ে বসবাস করে চলেছেন।
ফরিদের অপকর্মের বিশাল মরুভূমিতে পা চালাতে গিয়ে কেউ ছুটেছেন মরীচিকার পেছনে; আবার কেউ ঝরিয়েছেন চোখের জল। অবশ্য দুদকের আশীর্বাদে সেসব হাজারও ভুক্তভোগীর কান্না ও চোখের জল যেনো দুর্নীতির বিশাল মরুভূমির মাঝে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে নামে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তার বিরুদ্ধে শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা মুখ খুলতে না পারলেও গত ৯ সেপ্টেম্বর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ফরিদ আহমেদ চৌধুরীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী উদ্ধার করে মাদরাসা থেকে বের করে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।
কক্সবাজার আদর্শ মহিলা কামিল মাদরাসার সদ্য অবসরে যাওয়া এই অধ্যক্ষ ফরিদ আহমেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তুলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ছাড়াও বর্তমান সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ও কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন মাদরাসাটির শিক্ষক, কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, অধ্যক্ষ ফরিদ আহমেদ চৌধুরী প্রতিষ্ঠাকালীন ১৯৮৯ সাল থেকে মাদরাসাটির অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন শুরু করে ২০২৩ সালের ২ জুন অবসরে যান। আইনের তোয়াক্কা না করে মাদরাসা ক্যাম্পাসে বসতি গড়ে এখনো অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। ফরিদ আহমেদ চৌধুরী মাদরাসা কম্পাউন্ডে থাকা এতিমখানার কচি-কাঁচা শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে নিজের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করান।
অভিযোগ সূত্র মতে, মাদরাসা কম্পাউন্ডের ভেতরে থাকা ছৈয়দিয়া বালিকা এতিমখানার টাকা দিয়েই তিনি গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। তিনি মাদরাসা ও এতিমখানার টাকা দিয়ে ক্রয় করেন ব্যক্তিগত অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদ। এই সম্পদের মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নবনির্মিত ভবনের পূর্বপাশে ঝিলংজা মৌজায় ৯ কোটি ১০ লাখ টাকা মূল্যের এক একর ৮২ শতক জমি, রামুর কচ্ছপিয়া মৌজায় ২০ লাখ টাকা মূল্যের সাত একর ৪০ শতক জমি, ইনানী মৌজায় এক কোটি ৭৩ লাখ টাকা মূল্যের দুই একর চার শতক জমি, কক্সবাজার শহরের বাসটার্মিনাল এলাকায় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা মূল্যের আট শতক জমি ও কক্সবাজার পৌরসভা মৌজার পেতা সওদাগর পাড়ায় ৫০ লাখ টাকা মূল্যের ৪০ শতক জমি।
দুদকে দেয়া লিখিত অভিযোগে বলা হয়, ওই মাদরাসার একটি অংশ ছৈয়দিয়া বালিকা এতিমখানা। এ এতিমখানায় ১০২ জন শিক্ষার্থী থাকলেও টাকা আত্মসাৎ করার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নামে-বেনামে ১৭৫ জন শিক্ষার্থী।
মাদরাসার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আমান উল্লাহ বলেন, ‘অভিযোগের সবগুলোই সত্য।’ সাবেক অধ্যক্ষ ফরিদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘এ রকম অভিযোগ অতীতেও অনেক করা হয়েছে। তদন্তও হয়েছে। তবে মিথ্যা অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।’
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ