ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১, ৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

টাঙ্গাইলে একই আঙিনায় মসজিদ-মন্দির, ৫৪ বছর ধরে চলছে ধর্মীয় উপাসনা

প্রকাশনার সময়: ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২০:৪৫

টাঙ্গাইলের নাগরপুরে ৫৪ বছর ধরে একই আঙিনায় পাশাপাশি মসজিদ ও মন্দিরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে নামাজ ও শারদীয় দুর্গাপূজা। উপজেলা সদরের চৌধুরী বাড়ি এলাকায় এবারও মসজিদের পাশেই মন্দিরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুর্গাপূজা। আজান ও নামাজের সময় বন্ধ থাকছে পূজার কার্যক্রম। উভয় ধর্মের লোকজন বলছে তারা দীর্ঘদিন ধরে সম্প্রীতির সাথেই নিজ-নিজ ধর্মের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণ নাগরপুর।

সংশ্লিষ্ট্য সূত্রে জানা যায়, উপজেলা সদরের চৌধুরী বাড়িতে ৯২ বছর আগে ১৯৩২ সালের সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় উঝা ঠাকুর কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দির। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে এখানে চৌধুরী বাড়ি ক্লাব স্থাপিত হয়। ক্লাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতি বছরই ধুমধামের সঙ্গে পালন করা হয় দুর্গাপূজা। মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রায় ৪০ বছর পর ১৯৭২ সালে একই আঙিনায় নির্মাণ করা হয় নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। একই স্থানে মসজিদ আর মন্দির নিয়ে কখনও কারও কোনো সমস্যা হয়নি। সবাই মিলে-মিশে নিজেদের ধর্ম পালন করছেন।

সরেজমিনে বৃহস্পতিবার নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি কেন্দ্রীয় মসজিদ ও দুর্গা মন্দিরে গিয়ে দেখা যায়, মন্দিরে চলছে পূজার্চ্চনা। পূজারী ও দর্শনার্থীরা আসছেন প্রতিমা দেখতে এবং পূজায় অংশ নিতে। নির্ধারিত সময়ে আজান শুরুর আগেই থেমে যায় পূজার যাবতীয় কার্যক্রম। নামাজ শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পর আবার বেজে উঠলো মন্দিরের মাইক, ঢাক-ঢোলসহ উলুধ্বনি। শুরু হয় পূজার কার্যক্রম।

স্থানীয়রা জানায়, এ মন্দিরের নামকরণ করা হয় নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি উঝা ঠাকুর কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দির। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর এখানকার ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মন্দিরের পাশেই প্রতিষ্ঠা করেন নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। এরপর থেকেই পাশাপাশি চলছে দুই ধর্মের মসজিদ-মন্দিরের কার্যক্রম।

নামাজি ও পূজারীরা জানান, এখানকার মানুষ শান্তিপ্রিয়। কোনো দিন কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি দুই ধর্মের মানুষদের মধ্যে। সবাই সম্প্রীতির সাথে পাশাপাশি মসজিদ ও মন্দিরে নিজ-নিজ ধর্মের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। তাদের প্রত্যাশা যুগযুগ ধরে চলতে থাকবে এই সম্প্রীতি।

চৌধুরী বাড়ির সুপ্রিয় সাহা বলেন, এখানে পূজা উদযাপিত হচ্ছে, পাশেই মসজিদ আছে। হিন্দু-মুসলমান আমরা একত্রিত। আমাদের অনেক ভালো লাগে ।

শিক্ষার্থী সম্মৃদ্ধি সাহা বলেন, বাবা মায়ের সাথে আমরা পূজা দেখতে এসেছি। এসে খুব ভালো লাগছে। আমার অনেক সহপাঠিরাও এখানে এসেছে। মন্দিরের পাশেই মসজদি রয়েছে।

আরেক শিক্ষার্থী প্রীতি দাস বলেন, আমি ১০ বছর ধরে এই মন্দিরে দুর্গাপূজা দেখতে এবং পূজার আনন্দ উপভোগ করতে আসছি। মুসলমানদের নামাজের সময় আমাদের সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকছে। নামাজ শেষে পুনরায় পূজার কার্যক্রম করা হচ্ছে।

স্থানীয় লিপি চক্রবর্তী ও মিতু সাহা বলেন, ৫৪ বছর ধরে আমরা এখানে পূজা করছি। নামাজের সময়সূচি মেনে আমরা দুর্গাপূজা পালন করছি। নামাজের সময় আমার পূজার কার্যক্রম বন্ধ থাকে। মসজিদের লোকজন আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করছে। আমরাও তাদের সহযোগিতা করছি।

মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান সোহেল বলেন, ভাতৃত্বপূর্ণভাবে আমরা যার যার ধর্ম পালন করছি। এখানে কোন ভেদাভেদ করি না কে হিন্দ বা মুসলমান। বিপদে আপদে আমরা সব সময়ই তাদের সহযোগিতা করছি। বাংলাদেশে এটি যেনো নিদর্শন হয়ে থাকে, দেশের সমস্ত জায়গার মানুষ যেনো এভাবে চলতে পারে। এমন মূল্যবোধ ধারণ করলে পৃথিবীতে কোথাও অশান্তি হবে না।

মসজিদের ইমাম আব্দুল লতিফ বলেন, আমি এখানে প্রায় ৩৭ বছর ধরে ইমামতি করছি। মসজিদের প্রাশেই ঈদগাঁ ময়দান। তার পাশেই মন্দির রয়েছে। প্রতিবছরেই এ মন্দিরে পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দুর্গাপূজার সময় এখানে লোক সমাগম প্রচুর হয়। নামাজের সময় তারা পূজার কার্যক্রম বন্ধ রাখছে। আমরা তাদের সার্বিক সহযোগিতা করে থাকি।

চৌধুরী বাড়ি উঝা ঠাকুর কেন্দ্রীয় দূর্গা মন্দির ক্লাবের সভাপতি লিটন কুমার সাহা পোদ্দার বলেন, ৫৪ বছর ধরে আমরা এখানে পূজা পালন করছি। পাশাপাশি মসজিদ ও মন্দির একসাথে ধর্মীয় উৎসব পালন হয়। এতে কোন সমস্যা হয় না মুসলিম ধর্মের মানুষের। এখন পর্যন্ত মুলমানদের সাথে আমাদের ভেদাবেদ সৃষ্টি হয়নি।

নাগরপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রফিক বলেন, সনাতন ধর্মের লোক ও মুসলিম ধর্মের লোক সম্প্রীতি বজায় রেখে ধর্ম পালন করে আসছেন। এখানে কোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় না। আমরা সব সময়ই সর্তক অবস্থানে রেখেছি।

এ প্রসঙ্গে নাগরপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) দীপ ভৌমিক বলেন, একই আঙনায় মসজিদ ও মন্দিরে নিজ-নিজ ধর্ম সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রেখে নামাজ ও পূজা পালন করে আসছে। ফলে নামাজ ও পূজা পালনের সময় অতিতে কখনও কোন সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। এখানে সম্পীতির অন্যন্য উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে।

আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে উপজেলা প্রশাসন পক্ষ থেকে সব সময়ই মনিটরিং করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।

এ ব্যাপারে টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম শানতু বলেন, জেলায় ১১০০ ওপরে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিটি মণ্ডপে পুলিশ এবং আনসারের সদস্য দায়িত্ব পালন করছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনীও দায়িত্ব পালন করছে। এ ছাড়া পুলিশ সদস্যরা টহল দিয়ে যাচ্ছেন। মসজিদের পাশেই মন্দির এটি একটি দৃষ্টান্তস্থাপন করেছে। একই স্থানে নামাজ হচ্ছে, আবার পাশেই শান্তিপূর্ণভাবে পূজা চলছে। এটিই হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির বাংলাদেশ। এমন বাংলাদেশ আমরা সবাই প্রত্যাশা করি।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ