ঢাকা, শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২ আশ্বিন ১৪৩১, ২৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

অনিয়ম-দুর্নীতির আঁতুড়ঘর কক্সবাজারের খরুলিয়া তালিমুল কোরআন মাদ্রাসা

প্রকাশনার সময়: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩:৪৩

তিনি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করা যার দায়িত্ব। কিন্তু তিনিই কি না অনিয়ম আর দুর্নীতির চাদর মুড়িয়ে রয়েছেন রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায়। নিয়মের বালাই না থাকায় এতিমদশায় পরিণত হয়েছে মাদ্রাসাটি। সেই সঙ্গে শিক্ষার মানও তলানিতে ঠেকেছে। বলছি কক্সবাজার সদরের খরুলিয়া তালিমুল কোরআন মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল আমিনের কথা। তার বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট, শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি, কমিটি গঠনে নজিরবিহীন স্বজনপ্রীতি, পারিবারিক লাঠিয়াল বাহিনী ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করাসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। এরই মধ্যে গড়িয়েছে শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ পর্যন্ত। ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি রক্ষায় প্রতিকার চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরসহ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছে ছাত্র-ছাত্রীরা।

অভিযোগ উঠেছে, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া যাবতীয় অর্থ লোটপাট, প্রতিষ্ঠানের জিনিসপত্র বিক্রি, নিজের স্ত্রীকে শিক্ষিকা বানিয়ে অনুপস্থিত থেকে বেতন উত্তোলন, নৈশ্যপ্রহরীর বেতন আত্মসাৎ, আপন বোনকে আয়া পদে নিয়োগ দিয়ে দায়ীত্ব পালন না করে বেতন উত্তোলন, যথাসময়ে অডিট না করা এবং মা-ভাইসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ম্যানেজিং কমিটি গঠনে স্বেচ্ছাচারিতা ও বির্তকিত নানা সিদ্ধান্তের কারনে মাদ্রাসাটি এখন অনিয়ম আর দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিনত হয়েছে। এ কারণে ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানটির সুনাম নষ্ট হতে বসেছে।

শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭৫ সালে তার বাবা সাবেক চেয়ারম্যান মৌলানা মুক্তার আহাম্মদ মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। বাবার অবদান পুঁজি করে ১৯৯২ সাল থেকে মাদ্রাসাটিতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দখলে নেন আব্দুল্লাহ আল আমিন। ১৯৯৩ সালে মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত হওয়ার পর থেকে একটি পারিবারিক সিন্ডিকেট গড়ে তুলেন তিনি। নিজের স্ত্রীসহ পরিবারের সাতজনকে মাদ্রাসাটিতে চাকরি দেন এবং পরিবারের লোকজনকে দিয়ে পরিচালনা পষদ গঠন করে একটি লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করে মাদ্রাসাটির চার পাশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম কারেন।

সূত্র বলছে, প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল আমিনের স্ত্রী জুলেখা বিনতে নাসিম মাদ্রাসার একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষিকা। ২০০৮ সাল থেকে ক্লাসে তিনি অনুপস্থিত থেকেও নিয়মিত বেতন উত্তোলন করছেন। তার বোন জান্নাতুল মাওয়া এ্যামি একজন উচ্চ শিক্ষিত মহিলা। তাকে সামান্য আয়া পদে নিয়োগ দিয়েছেন সুপার আল আমিন। অথচ তিনি কোন প্রকার দায়ীত্ব পালন না করে বেতন নিচ্ছেন হর হামেশাই।

অনুসন্ধানে জানা যায়- মাদ্রাসাটির প্রধান আল আমিন এবং তার অন্যান্য অনুগত শিক্ষকদের পরস্পরের যোগসাজশে, স্থানীয় প্রভাব খাটিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় নানা অজুহাতে তিন যুগ ধরে মাদ্রাসাটির বিপুল সংখ্যক অর্থ হাতিয়েছেন। করোনাকালীন সময়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার থেকে দেয়া ৫ লাখ টাকা তিনি একাই মেরে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। এছাড়া ফরম ফিলাপের সময় বিভিন্ন স্তরভেদে শিক্ষার্থীদের টাকা দিতে হবে বলে বাধ্যতামূলক নির্দেশনা জারি করেন আল আমিন সিন্ডিকেট। এভাবে গত ৩১ বছরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যায় প্রায় কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষর্থীরা।

সূত্রের দাবি, প্রতিষ্ঠানটিতে তার অনুগত না থাকা কোন শিক্ষকদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। আল আমিনের পারিবারিক সিন্ডিকেট মাদ্রাসাটি ঘিরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠা মৌলবাদী চক্র অন্যদের সহ্য করতে পারছে না। তার মতের বাইরে যাওয়া শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে গেলেই যেনো বাঁচে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, শেখ রাসেল স্মৃতি ল্যাবের জন্য সরকার থেকে দেয়া ১৩টি ল্যাপটপ বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। প্রধান শিক্ষক আল আমিন টেন্ডার ছাড়াই প্রতিষ্ঠানের সবকিছু বিক্রি করে যাবতীয় টাকা আত্মসাৎ করে যাচ্ছেন। ফরম পূরণ ও রেজিস্ট্রেশনে সরকারের বেধে দেওয়া টাকার কয়েকগুণ বেশি টাকা নেন। নিয়োগ বাণিজ্য করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেন তারা। গরমে কষ্ট হলেও শ্রেণিকক্ষে ফ্যান চালাতে দেন না প্রধান শিক্ষক। শিক্ষার বিষয়ে ঠিকমতো তদারকি করেন না। এমনকি এত বড় প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনো কক্ষে ফ্যান পর্যন্ত নেই। প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো হুমকি-ধমকি দেন প্রধান শিক্ষকসহ তার লাঠিয়াল ভাইয়েরা।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে আমাদের প্রধান শিক্ষক মাদ্রাসাটির দায়িত্ব থাকা অবস্থায় বিভিন্ন অনিয়ম করে গেছেন। ইচ্ছাকৃতভাবে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে ভুল করে তা টাকার বিনিময়ে সংশোধন করতেন। দীর্ঘদিনের মাদ্রাসার হিসাব তিনি কর্তৃপক্ষকে দেননি। এছাড়া আরও বিভিন্ন অভিযোগে ইউএনও এবং মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বরাবর অভিযোগ করা হয়। গতকাল অভিযোগ তদন্তে এলে প্রধান শিক্ষক অভিযোগের কোনো সদুত্তর দিতে না পারায় কয়েকদিন সময় চেয়েছেন।

শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রধান শিক্ষক কখনো শ্রেণি কক্ষে পাঠদান করতেন না। এমনকি এসব অনিয়ম নিয়ে এলাকার কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে উল্টো তার ভাইদের দিয়ে হুমকি-ধমকি ও নানাভাবে হয়রানি করা হতো। এছাড়া কয়েক বছর থেকে মাদ্রাসাটির শিক্ষার মান কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। উপজেলা পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে শীর্ষে থাকা এ প্রতিষ্ঠানটি বিগত এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে উপজেলা পর্যায়ে একদম নিচে নেমে আসে।

স্থানীয় অভিভাবকদের দাবি, মাদ্রাসাটিতে সুপারের একক আধিপত্য। তার কথাই যেন শেষ কথা। তার আঙুলের ইশারায় হতো সব কাজ। প্রভাব এবং আধিপত্যের জোরে তটস্থ রাখে তার অধীনস্থ সবাইকে। ১৯৯২ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটি। অনিয়ম, দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহার মিলিয়ে আল আমিন নিজের শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে চলেন সব সময়। দায়িত্বে থাকা সুপার তার মাথায় ঘুরপাক খেতো মাদ্রাসার কাজ কার। তিনি যে রক্ষার দায়ীত্বে রয়েছেন সেটা যেন ভুলেই গেছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় তিনি যেন দুর্নীতির বরপুত্র হয়ে উঠেছেন।

স্থানীয়দের মতে, সম্প্রতি আল আমিনের অপসারণ চেয়ে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করলে তার এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করে প্রশাসন। কিন্তু সেখান থেকে রক্ষা পেতে বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত তার মামা-ভাইদের নিয়ে মোটা অংকের টাকার মিশন নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করতে মাঠে নামে।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মাদ্রাসাটির প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল আমিন। তার বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি তেমন কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। ছাত্রলীগের শিক্ষার্থীরা এসব তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন বলে দাবি করেন তিনি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন বলেন, তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে তদন্ত কমিটি। সত্যতা পেলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ