‘নদী আমার ঘরবাড়ি, জায়গা-জমি সব ভাইঙা নিছে। সেই শোকে চার মাস হইলো স্ত্রীও মইরা গেছে। সব হারাই ফেলাইছি, আমার আর কিছুই নাই। নদী আমার সব কাইড়া নিল! এই বয়সে অহন আমি কই যামু, কই থাকমু?’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন বৃদ্ধ সিদ্দিক শেখ (৮০)।
তিনি জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার চরপাকেরদহ ইউনিয়নের পাকরুল এলাকার বাসিন্দা।
সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সকালে যমুনার ভাঙনকবলিত পাকরুল এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় সিদ্দিক শেখের সঙ্গে। তার চোখে-মুখে কষ্ট আর হতাশার প্রতিচ্ছবি। এক সময় আবাদি জমি, বসতভিটা, ফলের বাগান ও সাজানো সংসার ছিল; কিন্তু এখন কিছুই নেই। যমুনার ভাঙনে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন জামাতার বাড়িতে। সেই বাড়িও এখন ভাঙনের মুখে পড়েছে।
জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার যমুনার পানি বেড়ে যাওয়ায় আবার তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনের আশঙ্কায় নদীর তীরবর্তী পরিবারগুলো তাদের বসতঘর অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়েছে। গত কয়েক বছরে পাকরুল এলাকার বেশিভাগ বসতভিটা ও ফসলি জমি বিলীন হয়েছে। চলতি বছর বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে নদীভাঙনে দুই শতাধিক বসতবাড়ি ও সাড়ে ছয়শ বিঘা ফসলি জমি বিলীন হয়েছে। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে হিদাগাড়ী কমিউনিটি ক্লিনিক, আশ্রয়ণ প্রকল্পের শতাধিক ঘরসহ কবরস্থান ও পাকা মসজিদ, যা নদী থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, গত কয়েক বছরেও নদীভাঙন রোধে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যার ফলে গোটা একটি এলাকা নদীগর্ভে চলে গেছে। আবার ভাঙন রোধে সাময়িক যে প্রকল্প দেওয়া হয়েছিল তাও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। নদীতে নামমাত্র জিও ব্যাগ ফেলে আওয়ামী লীগের কয়েক নেতা ও স্থায়ীয় প্রভাবশালীরা ওই প্রকল্পের টাকা নয়ছয় করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ, দবিরুল ইসলাম ও সুজা মিয়া বলেন, গত এক বছরে নদী ভাঙনে প্রায় ৫ শতাধিক বসতভিটা ও ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। আরও শতাধিক বসতভিটা, কমিউনিটি ক্লিনিক, আশ্রয়ন প্রকল্পের শতাধিক ঘরসহ কবরস্থান ও পাকা মসজিদ ভাঙনের মুখে পড়েছে। গত কয়েক দিনে অনেকে বসতভিটা ও ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে প্রাইমারি স্কুল, মাদরাসা, মসজিদ, কবরস্থান, বৈদ্যুতিক খুঁটিসহ মানুষের বিভিন্ন স্থাপনা।
পাকরুল এলাকার নিজাম মন্ডল জানান, গত কয়েক মাস আগে তার ঘরবাড়ি, ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। সব হারিয়ে তিনি এখন নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
একই গ্রামের অহর উদ্দিন মোল্লা জানান, গতকয়েক বছরে নদীভাঙনে তার বাবা-দাদার বসতবাড়িসহ আশপাশের মানুষের শত শত বাড়িঘর বিলীন হয়েছে। বিগত সময়ে জনপ্রতিনিধিরা ভাঙন রোধে কাজ করার আশ্বাস দিলেও শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
একই এলাকায় খাইরুল ইসলাম বলেন, চরপাকেরদহ ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড পাকরুল এলাকা পরোটাই নদীগর্ভে চলে গেছে। যাদের বসতবাড়ড়ি ভেঙে গেছে, তাদের থাকার মত কোন জায়গা নেই। তাদের কেউ খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। আবার কেউ আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। তিনি ভাঙন রোধে দ্রুত স্থায়ী বাঁধ র্নিমাণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
স্থায়ীয় বাসিন্দা আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, তার ২০ বিঘা ফসলি জমি নদীতে ভেঙে গেছে। এখন তার বসতভিটাও ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে।
চরপাকেরদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বদরুল আলম সরদার বলেন, বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই পাকরুল এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। এরমধ্যে প্রায় দুই শতাধিক বসতবাড়ি ও কৃষি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক, পাকা মসজিদ, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরসহ আরও দুই শতাধিক বসতবাড়ি।
জামালপর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, মাদারগঞ্জের পাকরুল এলাকায় যমুনা নদীর বাম তীরে ভাঙন শুরু হয়েছে। সেখানে জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হচ্ছে। পাশাপাশি সেখানে ১৫শ মিটার অংশে নদীর তীর সংরক্ষণের কাজ বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রকল্প দাখিল করা হয়েছে, যা পরিকল্পনা কমিশনে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হওয়ার পর বাস্তবায়ন হলে ওই এলাকার নদী ভাঙন অনেকটাই লাঘব হবে।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ