ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

দাফন করার ছয়দিন পর হাসপাতালে পেলেন ছেলেকে

প্রকাশনার সময়: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:৫১ | আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:৫৬

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়লে পাড়ামহল্লা থেকে লাখ লাখ মানুষের ঢল নামে নবীনগর চন্দ্রা মহা সড়কের বাইপাইলে।

জনতার সেই ঢলে যোগ দেন হতদরিদ্র বাবার মাদ্রাসা পড়ুয়া ছেলে মো. রিফাত হোসেন। ওইদিন বিকেল সাড়ে ৩টায় বাসা থেকে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আনন্দ মিছিল করতে বেড়িয়ে পড়ে সে।

মো. রিফাত হোসেন (১৯) বগুড়া জেলা গাবতলী থানা পারানিপাড়া গ্রামের মো. লুৎফার প্রামাণিকের ছেলে। সে পোশাক শ্রমিক মা ও নির্মাণ শ্রমিক বাবার সঙ্গে আশুলিয়ার পলাশবাড়ী বটতলা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকত এবং নয়ারহাট এলাকার সিন্ধুরিয়া দারুল ইসলাম ফাজিল মাদ্রাসার আলিম দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।

মুহুর্মুহু গুলির শব্দে প্রকম্পিত বাইপাইল এলাকা। বিপদ আচ করতে পেরে ছেলের মোবাইল ফোনে কল দিতে থাকেন মা-বাবাসহ আত্মীয় স্বজনরা। এ সময় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ফোনটি রিসিব করে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেন। তারপর ফোনটি বন্ধ করে দেয়।

রাতে গুলির শব্দ থেমে গেলে ছেলের সন্ধানে বের হন রিফাতের মা-বাবা। কোথাও খুঁজে না পেয়ে বাসায় আসেন। ৬ তারিখ ভোরে ফের খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। কয়েকটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হন তারা। এর মধ্যে লোকমুখে জানতে পারে, আশুলিয়া থানায় কয়েকটা লাশ আছে। ছেলের সন্ধানে থানার দিকে রওনা হতেই দেখেন থানার সামনে ওভারব্রিজে দুটি লাশের পায়ে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেছে। পিলে কেঁপে ওঠে তাদের। ঝুলিয়ে রাখা লাশগুলো ছিল পুলিশ সদস্যদের। অনেক সাহস করে থানার সামনে যেতেই দেখেন অনেকগুলো পোড়া লাশ পড়ে আছে। ওখান থেকে একটি লাশ নিজেদের ছেলে রিফাত হোসেনের দাবি করে অ্যাম্বুলেন্স যোগে ওইদিন বগুড়ার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করেন। এদিকে ছেলের লাশ দাফনের ছয়দিন পর সাভারের এনাম মেডিকেলে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় খুঁজে পান ছেলেকে।

ছেলের দাফন শেষে চার দিন পর মিলাদ পড়িয়ে ১০ আগস্ট ঢাকার আশুলিয়ায় আসেন রিফাতের বাবা-মা। বাসায় এসে পরের দিন জানতে পারেন তাদের ছেলে এনাম মেডিকেলে আহতাবস্থায় চিকিৎসা নিচ্ছে। রিফাতের বন্ধুরা ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারে রিফাত মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে সাভারের এনাম মেডিকেলে চিকিৎসাধীন আছে।

এ খবর শুনেই রিফাতের মা-বাবাসহ বন্ধুরা যান এনাম মেডিকেলে। ছেলেকে আবিষ্কার করেন মেডিকেলের আইসিইউতে। ডাক্তাররা জানান, মাথায় এখনো গুলি আছে। জরুরি অপারেশন করাতে হবে।অপারেশন না করলে ছেলে বাঁচানো যাবে না। তাদের আহাজারিতে কেউ এগিয়ে না আসলেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন বাংলাদেশ জামাতে ইসলামীর নেতা কর্মীরা। এনাম মেডিকেল থেকে নিয়ে জামাতে ইসলামীর তত্তাবধানে কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক সেন্টাল হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা দেন।

আশুলিয়া থানধীন পলাশবাড়ী বটতলা নামক এলাকায় রিফাতদের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, হাড্ডিসার শরীর। খালিয়ে গায়ে বসে আছে রিফাত হোসেন। কাউকে চিনতে পারেনা। সে কোন মাদ্রাসায় কোন ক্লাসে পড়ত তা-ও বলতে পারে না। পাশে মা পারুল বেগম বসে ছেলের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না কোনোভাবেই। ছেলের কাছে বসে ক্ষণেক্ষণে মূর্ছা যাচ্ছেন মা। রিফাতের মাথায় অপারেশন করার পর শরীরের একপাশ প্রায় অবস হয়ে গেছে। মানসিক ভারসাম্যও হারিয়েছে।

রিফাতের মা পারুল বেগম বলেন, আমার ছেলে মনে করে আশুলিয়া থানার সামনে থেকে একটি পোড়া লাশ বাড়িতে নিয়ে দাফন করেছি। দাফন শেষে ঢাকায় এসে ছেলেকে পেয়েছি। ওটা কার লাশ এখনো খোঁজ হয়নি।

আমার ছেলে মাদ্রাসায় ভালো ছাত্র ছিল। আলিম পাস করত এ বছর। ছেলের এমন দেখে চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।সারাক্ষণ তার কাছে থাকতে হয়। ডাক্তাররা বলেছে, আরও উন্নত চিকিৎসা করাতে হবে। এখন আমার স্বামীর একা রোজগারে সংসারই চলেনা, চিকিৎসা করাবো কেমনে?

মো. লুৎফার প্রামাণিক বলেন, আমি রাজমিস্ত্রির কাজ করি। ছেলের এমন করুণ দৃশ্য সইতে পারি না। আমার ছেলের চিকিৎসার জন্য জামায়াতে ইসলামী ছাড়া কেউ সহযোগিতা করেনি। একা রোজগার করে খাওয়া দাওয়া আর বাসা ভাড়া যোগার করতেই হিমশিম খাচ্ছি। ছেলেকে চিকিৎসা করাব কেমনে। কেউ যদি আমার ছেলেকে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিত তাহলে ভালো হয়ে যেত।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ