চট্টগ্রাম কোতোয়ালী থানা। ‘যাত্রী সেবা’ ঘরে বসে আছেন এক পুলিশ সদস্য। তাকে ঘিরে বসে আছেন কিছু সাধারণ মানুষ, যাদের বেশিরভাগই থানায় এসেছেন সাধারণ ডায়েরি বা জিডি করতে।
ডিউটি অফিসারের দায়িত্বে থাকা এএসআই মাহবুব বললেন, থানার ভিতরে বসার অবস্থা নেই। পরিষ্কার আর সংস্কারের কাজ চলছে। তাই এ কক্ষে বসেই কাজ করতে হচ্ছে। পুলিশের এই কর্মকর্তার ভাষ্য, ৮ আগস্ট থেকে তারা স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করেছেন। লোকজন আসছেন সেবা নিতে তবে বেশিরভাগ জিডি করতে। এর মধ্যে আবার মোবাইল হারানোর জিডিই বেশি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা হয়। জ্বালিয়ে দেয়া হয় কোতোয়ালী, পাহাড়তলী, পতেঙ্গা, ইপিজেড থানা। লুটপাট হয়েছে অস্ত্রাগার, মালখানা। কোতোয়ালী, পাহাড়তলী থানা ভবনের অবকাঠামো ছাড়া অবশিষ্ট কিছুই নেই। আর পতেঙ্গা ও ইপিজেড থানা একেবারেই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে।
এক পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্য, পুলিশ এখন ‘ঢাল তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দার’। অস্ত্র, গাড়ি, লজিস্টিক- কিছুই নেই। পুলিশ লাইন্স থেকে নতুন জিনিসপত্র পাঠানো হচ্ছে, তবে সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। পরিস্থিতির কারণে কোথাও কোনো অভিযান নাই, কোনো তদন্তে যেতে পারছে না। কারো সমস্যা হলেও পুলিশ দ্রুত সাপোর্ট দিতে পারছে না। তবে হতাশার মধ্যেও আবার ঘুরে দাঁড়ানোর আশার আলো দেখছি এটাই আমাদের সান্ত্বনা,’ বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই পুলিশ কর্মকর্তা। পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পুলিশ দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও ঘটনার ১০ দিন পরও এককভাবে টহলে যাচ্ছে না। প্রতিদিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ টহল পরিচালনা করছে থানার টিমগুলো। গতকাল বেলা ১২টার দিকে পাহাড়তলী থানায় গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন শ্রমিক মূল ফটক মেরামতের কাজ করছেন। কোতোয়ালীর মতো এ থানাটিও জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। ভবনের অবকাঠামো ছাড়া অবশিষ্ট কিছুই নেই।
থানার ভিতরে ঢুকতেই দেখা যায়, একটি বড় কক্ষে বসে আছেন ওসি কেপায়েত উল্লাহ। একই রুমে বসে আছেন আরো পাঁচ-ছয় জন কর্মকর্তা, পুরুষ ও নারী কনস্টেবলরা, নিজেরা গল্প করছেন।
ওসি কেপায়েত উল্লাহ বলেন, থানা আক্রমণের পর তাদের অস্ত্রাগার লুট করে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে থানার সব গাড়ি। তিনি বলেন, থানার সব নথিপত্র পুড়ে গেছে। কম্পিউটার থেকে শুরু করে বিভিন্ন জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়ে গেছে। আমরা তো কোথাও মুভ করতে পারছি না। দৈনন্দিন দাপ্তরিক কাজগুলো কম্পিউটারের পরিবর্তে কাগজে কলমে এবং মোবাইলে লিখে চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। তবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রতিদিন থানার পুলিশ সদস্যরা পেট্রোলিং ডিউটি করছে। গত এক সপ্তাহে থানায় কেউ জিডি কিংবা মামলা করেনি বলেও জানান ওসি। হালিশহর থানার ওসি কায়সার হামিদ বলেন, থানার বাইরে গাড়িতে আগুন দিয়েছে। থানা ভবনে আগুন না দিলেও আসবাবপত্র থেকে শুরু করে সব কিছুই লুটপাট করে নিয়ে গেছে। থানায় কোনো কম্পিউটার নেই, কাগজে-কলমে দাপ্তরিক কার্যক্রম চলছে। অনলাইন না থাকায় সাধারণ ডায়েরি নেয়া হচ্ছে পুরোনো পদ্ধতিতে। শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতা ছাড়ার পর নগরজুড়ে পুলিশের স্থাপনায় যে হামলার ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে পতেঙ্গা ও ইপিজেড থানা ভবন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। পতেঙ্গার ওসি মাহফুজুর রহমান হামলার আগের দিন ৪ আগস্ট থানায় যোগ দেন। পরদিনই থানা আক্রমণের ঘটনা ঘটে।
ওসি মাহফুজ বলেন, ‘থানা ভবন আর ব্যবহারের উপযোগী নেই। কর্ণফুলী টানেলের পশ্চিম প্রান্তে যে ফাঁড়ি নির্মাণ করা হয়েছিল সেখানে থানার দাপ্তরিক কাজ চলছে। লোকজন জিডি করতে এলে আমরা সেগুলো গ্রহণ করছি।
এই থানার ওসি মোহাম্মদ হোসেন বলেন, শনিবার থেকে তাদের থানার দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গত ছয় দিন ধরে বন্দর ৫ নম্বর গেইট সংলগ্ন নিউমুরিং পুলিশ ফাঁড়িতে দাপ্তরিক কাজ করেছেন তারা। শুক্রবার থেকে ফ্রি পোর্ট সংলগ্ন ইপিজেড পুলিশ ফাঁড়িতে তাদের দাপ্তরিক কাজ করবেন। পুরোনো একটি ভবনে আগে থানার কার্যক্রম পরিচালিত হতো। এখন সেটি ব্যবহারের অনুপযোগী। থানার কাছে ইপিজেড ফাঁড়ি সংস্কার করা হয়েছে। সেখানে আমরা আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করব। থানায় যারা জিডি করতে আসছেন তাদের জিডি গ্রহণ করা হচ্ছে বলেও জানান ওসি মোহাম্মদ হোসেন। তবে যেসব থানায় হামলার ঘটনা ঘটেনি সেগুলোতে কার্যক্রম চলছে স্বাভাবিক।
চান্দগাঁও থানায় গত ৫ আগস্ট এই থানায় হামলার চেষ্টা হলেও ভিতরে ঢুকতে পারেনি লোকজন। থানার ফটক ও ঢিলের আঘাতে জানালার কয়েকটি কাচ ভাঙলেও স্বাভাবিক অবস্থায় আছে থানা ভবন। গতকাল চান্দগাঁও থানায় গিয়ে দেখা যায়, ডিউটি অফিসারের কক্ষে কয়েক জন নারী দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলছেন ডিউটি অফিসার।
নিজ কক্ষে পাওয়া যায় ওসি জাহিদুল কবীরকে। থানা ভবন অক্ষত থাকায় নিজ নিজ কক্ষে বসে কাজ করতে দেখা গেছে অন্যান্য কর্মকর্তাদেরও।
ওসি জাহিদুল কবীর বলেন, ‘থানা অক্ষত থাকায় আমরা প্রতিদিন অফিসে এসেছি। ৯ তারিখ থেকে আমরা আমাদের কার্যক্রম শুরু করেছি। লোকজন আসছেন, তাদের সেবা দেয়ার চেষ্টা করছি। চারটি মাদক ও একটি মারামারিসহ এক সপ্তাহে পাঁচটি মামলা রেকর্ড হয়েছে। সাতটি হারানো জিডি ও পাঁচটি নন জিআর জিডি হয়েছে। থানায় কোনো সমস্যা না হওয়ায় অনলাইনে জিডি গ্রহণ করা হচ্ছে।’ ওসি বলেন, আমরা স্বাভাবিক কার্যক্রম করার চেষ্টা করছি। প্রতিদিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ অভিযানে যাচ্ছে আমাদের সদস্যরা।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ