ঢাকা, রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

‘তোরা হামার ছোলের বুকোত গুলি মারলু ক্যা’

প্রকাশনার সময়: ২৮ জুলাই ২০২৪, ১৬:৩২ | আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২৪, ১৬:৩৪

`ছেলের বুকে গুলি লাগছে গত ১৯ জুলাই। চারদিন হাসপাতালের বেডে কাঁতরাইছে। ছেলে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে জ্যানেও তার পাশে থাকতে পারিনি। কতই না কষ্ট প্যায়ে মারা গেছে। কতই না আর্তনাদ করিছে। এমন কষ্ট আল্লাহ য্যান আর কাউকে না দেয়।’

কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন নারায়ণগঞ্জের ডিআইটি রোডে গুলিতে মারা যাওয়া কিশোর রাসেলের (১৫) বাবা পিন্টু রহমান।

মা অঞ্জনা খাতুন শোকে মুষড়ে পড়েছেন। ছেলে হারানোর শোক সইতে না পেরে বার বার বিলাপ করছেন। ছেলে শোকে মুখে কোনো দানাপানি নিচ্ছেন না তিনি।

গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের ডিআইটি রোডের দেওভোগ মার্কেটের ২ নম্বর গেটের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয় রাসেল। আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাসেলের বুকে একটি বুলেট বিদ্ধ হয়েছিল। রোববার তার শরীরে অস্ত্রোপচার করে বুলেট বের করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত সোমবার রাতে মারা যায় রাসেল। তার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায় মঙ্গলবার দুপুরে। ওই দিনই দাফন করা হয়।

রাসেলের বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার কশব ইউনিয়নের ভোলাগাড়ী গ্রামে। বাঁশ-খড়ের বেড়া আর টিনের ছাউনির ছোট্ট একটি বাড়ি। রাসেলের বাবা পিন্টু রহমান দিনমজুরি করে সংসার চালায়। চার ভাই-বোনের মধ্যে রাসেল সবার ছোট। তার এক বোন মানসিক প্রতিবন্ধী।

শনিবার (২৭ জুলাই) বেলা ৩টার দিকে রাসেলের বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই ভেতর থেকে নারী কণ্ঠের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে প্রতিবেশী এক নারী বাড়িতে গিয়ে রাসেলের চাচা আব্দুর রশিদকে ডেকে আনেন।

আব্দুর রশিদ জানান, ‘রাসেলের গুলিবদ্ধ হওয়ার খবর শোনার পর থেকেই তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মুখে কোনো দানাপানি নিচ্ছে না। না খেয়ে খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন রাসেলের বাবা।’

তিনি আরও বলেন, ‘সংসারের অভাবের কারণে রাসেল ক্লাস টু-থ্রি পর্যন্ত পড়ার পর আর স্কুলে যায়নি। গত দেড় বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের আখেড়া এলাকায় একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে ছয়-সাত হাজার টাকা বেতনে কাজ করছিলো তিনি। কুরবানির ঈদের ছুটি শেষে ১২-১৩ দিন আগে নারায়ণগঞ্জে ফিরে যায়। আর এখন সে বাড়িতে ফিরে আসলো লাশ হয়ে।’

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর রাসেলের মা অঞ্জনা খাতুনকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন বাবা পিন্টু রহমান। পরে তিনি বলেন, ‘গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) বিকেল ৫টার দিকে ছেলের সঙ্গে হামার শেষ কথা হয়। মা ও বোনেরা ক্যামন আছে, এগুলা খোঁজ নিলো। ওই দিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাসেলের ফোন থ্যাকে কল আসে। কল ধরার পর অন্য এক লোক জানায়, রাসেলের বুকতে গুলি লাগিছে। ঢাকা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এর মধ্যে শুনি কারফিউ জারি হয়ে গেছে। ঢাকা যাওয়ার কোনো গাড়ি না পাওয়ায় আর য্যাতে পারিনি।’

পিন্টু রহমান বলেন, ‘হামার ছেলে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়োছে জ্যানেও তার পাশে থাকতে পারিনি। একটা মা-বাবার জন্য এর চ্যায়ে চরম কষ্ট আর কি হতে পারে। গুলি লাগিছে শুক্রবার। চার দিন ধরে হাসপাতালের বেডে কাঁতরাইছে। কতই না কষ্ট প্যায়ে মারা গেছে। কতই না আর্তনাদ করিছে। এমন কষ্ট য্যান আল্লাহ আর কাউকে না দেয়।’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

কশব ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য ও প্রতিবেশী পাঞ্জব আলী বলেন, ‘রাসেলের বাবা একেবারে গরিব। দিনমজুরি করে কোনোরকম সংসার চালায়। তিন মেয়ের মধ্যে একটা প্রতিবন্ধী। আর দুই মেয়ের মধ্যে একটার বিয়ে হইছিলো। বিয়ের কিছু দিন পরেই স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়। এখন সে বাবার বাড়িতেই থাকে। ছেলেটা গার্মেন্টেসে দেড় বছর ধরে কাজ শিখতেছিল। ছয়-সাত হাজার বেতনে কোনো রকম নিজে চলতে পারতো। আর কিছু দিন গেলে হয়তো কাজ শিখলে বেতন বাড়তো। তখন হয়তো সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা ফিরতো। কিন্তু তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল।’

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ