ঢাকা, রোববার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাধের দুর্গ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলছে খুনোখুনি, বাড়ছে উদ্বেগ

প্রকাশনার সময়: ২১ জুন ২০২৪, ১৬:৩৪

কক্সবাজার নানা অপরাধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবির । ইয়াবা পাচার, ডাকাতিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের আধিপত্য বিস্তার এমনকি তুচ্ছ ঘটনায় প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ ও খুনোখুনিতে মেতে উঠেছেন তারা। গত ছয় মাসে তুচ্ছ ঘটনায় অন্তত ২৬ জন খুনের শিকার হয়েছেন। এছাড়া ২০২৩ সালে খুন হন ৬৪ জন। এর আগে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরে ১৩২টি খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দারাও রয়েছেন।

প্রতিটি হত্যাকাণ্ডেই ব্যবহার হয়েছে ধারালো অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র। এমন পরিস্থিতিতে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যদের। উদ্ধার করা হচ্ছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ। তারপরও থামানো যাচ্ছে না রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের।

এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের জন্মভূমিতে ফেরা নিয়েও দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। স্থানীয়দের দাবী, শুধু রাতে নয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন দিনেও চলছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। ক্যাম্পেই পরস্পরবিরোধী একাধিক রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপ এখন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই ক্যাম্পগুলোর সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খুনোখুনি, অপহরণ, গুম, লুটপাট সেখানে এখন স্বাভাবিক ঘটনায় রূপ নিয়েছে।

পর্যটননগরী কক্সবাজারের টেকনাফ যেন এখন মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরসা ও আরএসওর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এই দুই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যরাও। ইতিমধ্যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা খুন হয়েছেন। এছাড়াও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে খুন হন রোহিঙ্গাদের সর্বোচ্চ নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহ। শুধু তাই নয়, টেকনাফের আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল, হোয়াইক্যং আলহাজ আলী আছিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দপ্তরী রশিদ আহমদ, হ্নীলার যুবলীগ নেতা ওমর ফারুককেও হত্যা করতে মোটেই কার্পণ্য করেননি। এমন পরিস্থিতিতে এই দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যদের তালিকা নিয়ে অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আরসার সদস্যরা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য আন্দোলন করছে। এ ক্ষেত্রে আরএসওর বেশির ভাগ নেতাই প্রত্যাবাসনের বিরোধিতা করছে। এ নিয়ে আরসা ও আরএসও'র মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে। এ কারণে দুই গ্রুপের মধ্যে খুনোখুনি ও হামলার ঘটনা বেড়ে চলেছে।

এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতনরা আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য না দিলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানায়, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, মানবপাচারসহ গুরুতর অপরাধের সঙ্গে এই দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আরসার সদস্যরা অস্ত্র ও মাদক চোরাকারবারে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তারা ক্যাম্পের সদস্যের তালিকায় নাম লেখালেও বেশির ভাগ সময় শূন্যরেখায় অবস্থান করে। আবার কিছু সদস্য সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশে সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে।

জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত ক্যাম্পগুলোতে ২৬ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে যাদের বেশির ভাগই নেতৃস্থানীয়। এদের মধ্যে ৪ জন ক্যাম্পে স্বেচ্ছায় ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করছিলেন। মূলত রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যার পরই ক্যাম্পে নিজেদের নিরাপত্তায় তারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়োজিত হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, শিবিরে প্রায় এক ডজন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। এদের মধ্যে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্যরা প্রায়ই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ জড়িয়ে পড়ছে।

পুলিশ ও র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) তথ্য মতে, শরণার্থী শিবিরে চাঁদাবাজি ও মাদক চোরাচালানকে ঘিরে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে হামলা, সংঘর্ষ ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটছে। এতে চলতি বছরের শুরু থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত চার কমিউনিটি নেতাসহ ২৬ রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়েছেন। ২০২৩ সালে হত্যার শিকার হন ৬৪ জন। এর আগে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরে ১৩২টি হত্যাকাণ্ড ঘটে। হত্যার শিকার অধিকাংশই ছিলেন রোহিঙ্গা নেতা বা মাঝি। শুধু তাই নয়, অস্থিরতা তৈরী করতে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটানো হয়েছে।

তারা জানান, কথিত সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। শুধু এক স্থানে না, একযোগে অন্তত পাঁচটি জায়গায় আগুন ধরিয়ে দেন। সর্বশেষ গত ১৪ মে উখিয়ার একটি শিবিরের হেড মাঝি মোহাম্মদ ইলিয়াসকে (৪৩) ঘর থেকে তুলে নিয়ে গুলি করে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে আরসার বিরুদ্ধে। এর আগে ৬ মে উখিয়ার বালুখালী শিবিরে রোহিঙ্গা নেতা জাফর আহমদকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গুলি করে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ধারণা করা হচ্ছে, সেই হত্যাকাণ্ডেও আরসা জড়িত।

উখিয়া বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা নুর হোসাইন বলেন, ক্যাম্পে হঠাৎ ফের সন্ত্রাসীদের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। যার কারণে ক্যাম্পে মারামারি- খুনখারাবির ঘটনা বাড়ছে। মূলত আরসা আরএসও'র মধ্য আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গোলাগুলির ঘটনা প্রতি রাতেই ঘটছে। তাদের দ্বন্দ্বের কারণে অনেক সময় সাধারণ রোহিঙ্গারা মারা যাচ্ছে।

বেশ কয়েক জন রোহিঙ্গা মাঝি জানান, শিবিরের সব জায়গায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তারা নিজেদের কৌশল পরিবর্তন করেছে। এখন আর আগের মতো দল বেঁধে অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে চলাফেরা করে না তারা। কাউকে টার্গেট করলে সুবিধামতো সময়ে হামলা করে।

কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নেতা মোহাম্মদ আমিন বলেন, কোনো একটি সশস্ত্র গ্রুপ একটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর আরেকটি গ্রুপ পাল্টা হামলা করে সেই এলাকার দখল নেয়ার চেষ্টা করে। মূলত ক্যাম্পে ফের আরসা আরএসও'র মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যা বাড়ছে। এছাড়া মিয়ানমারের চলমান যুদ্ধে অংশ নিতে ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের পাঠানো নিয়েও এদের মধ্যে সংঘাত হচ্ছে।

উখিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ শামিম বলেন, ক্যাম্পে মাঝি (রোহিঙ্গা নেতা) ও স্বেচ্ছাসেবীদের কারণে অপরাধীদের কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়। তাই অনেক সময় ক্ষিপ্ত হয়ে সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। এছাড়া ক্যাম্পে নতুন করে সন্ত্রাসীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। কোনো সন্ত্রাসী দলকে আমরা এখানে ঠাঁই হতে দেব না। পাশাপাশি ক্যাম্প এলাকায় টহল এবং নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, দুটি কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কমিউনিটি নেতাদের খুন করছে কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। এক হচ্ছে, কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ব্যাপারে কেউ তথ্য দিলে তা তারা জেনে যায়। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে। তথ্যদাতাকে ধরে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে। কারণ ক্যাম্পে তাদের অসংখ্য নেটওয়ার্ক রয়েছে। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, আগে অনেক কমিউনিটি নেতা কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা করত। কিন্তু এখন না করাতে মুনাফিক হয়ে গেছে বলে টার্গেট করে হত্যা করছে।

আর শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে তো আমরা অবশ্যই চিন্তিত। তবে ক্যাম্পে ৩টি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) রয়েছে। সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছে ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি। তারা প্রতিনিয়ত কাজ করছে। আমরা তাদের সঙ্গে সমন্বয় করছি। এ ছাড়া বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। তারপরও কিছু ঘটনা ঘটছে। তবে এসব ঘটনা নিয়ে আমরা কিছুটা চিন্তিত। আমরা সবাই চেষ্টা করছি, কীভাবে ক্যাম্পে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বে থাকা ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. আমির জাফর বলেন, ক্যাম্পে বেশ কিছু গ্রুপ কাজ করে। যাদের কাজ হচ্ছে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ। আর এসব নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে আধিপত্য বিস্তার একটা বিষয় থাকে। এরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে এসব অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করছি। কখনো এপিবিএন পুলিশ একা করছে, কখনো জেলা পুলিশ বা র‍্যাবকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছে। তবে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় আশা করি, ক্যাম্পের এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

নয়াশতাব্দী/এনএইচ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ