মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১

সিলেটে বন্যার অবনতি

প্রকাশনার সময়: ২০ জুন ২০২৪, ০৮:৪১

সিলেটের নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ৪ দিনের টানা বৃষ্টিপাত ও উজানের পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকার কারণে গতকাল বুধবার জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। এতে বাড়ছে পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা। সরকারি হিসাবে মঙ্গলবার থেকে বুধবার দুপুর পর্যন্ত তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাত লাখের মতো। তবে স্থানীয়দের দেয়া তথ্যমতে পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। সিলেট মহানগরীকে দুই ভাগে বিভক্ত করা সুরমা নদীর পানিতে তীরবর্তী ওয়ার্ডগুলোর বাসা-বাড়িসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ফলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বন্যার্তদের।

সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, জকিগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারের পাশাপাশি বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে সদর, দক্ষিণ সুরমা, বিশ্বনাথ, ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বালাগঞ্জ উপজেলায়।

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। নতুন করে কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে; তবে পানির লেভেল আগের থেকে বাড়েনি। বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার নতুন করে আরও বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন বন্যা পরিস্থিতির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। তিনি জানান, বুধবার দুর্যোগ ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিবুর রহমান সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, সিটি করপোরেশন এবং ওসমানীনগরে বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শন ও বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করবেন।

সিলেট জেলা আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন, মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আর বুধবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত মাত্র তিন ঘণ্টায় ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৭ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস বলেন, বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। তাই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে সময় লাগবে। গত ৫ দিনে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ১ হাজার ৬০০ মিলিমিটারের উপরে বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিপাত একটু কমেছে; ১১০ মিলিমিটার হয়েছে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর বলেন, নগরীর ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২২টি ওয়ার্ডের ৮০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়েছেন। নগরীর ৮০টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে ২২টিতে মানুষজন উঠেছেন। সিটি করপোরেশন মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর নির্দেশনায় আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও বন্যাকবলিত এলাকায় রান্না করা ও শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে।

বালাগঞ্জের বাসিন্দা ও স্থানীয় সাংবাদিক তারেক আহমদ বলেন, বালাগঞ্জ উপজেলার বেশির ভাগ এলাকায় পানি রয়েছে। এসব এলাকার মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। পানি বেড়েই চলছে। বালাগঞ্জ-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কে পানি থাকায় যানচলাচল বন্ধ রয়েছে। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সরজমিন সিলেট নগরীর তালতলা, জামতলা, যতরপুর, সোবাহনীঘাট, মেন্দিবাগ ও উপশহর এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর রাস্তাঘাট-বাসাবাড়ির কোথাও-কোথাও হাঁটু থেকে কোমর পানিও রয়েছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা নোংরা পানি মাড়িয়ে চলাচল করছেন। পানিবন্দি এলাকার মানুষজন কেউ যাচ্ছেন ভ্যানে, কেউবা রিকশায়। বিশেষ করে উপশহরের বাসিন্দাদের নৌকা ও ভ্যানে চলাচল করতে হচ্ছে। তাদের ভাষ্য, বাধ্য হয়েই চলাচল করতে হচ্ছে। ঈদের দিন ভোর থেকে নগরীর পাড়া-মহল্লায় পানি উঠতে শুরু করে। মঙ্গলবার বিকালে কিছুটা কমলেও বুধবার আবার বেড়েছে পানি। তালতলা পয়েন্টের ব্যবসায়ী এনামুল হোসেন বলেন, কয়েক দিন ধরে পানি রয়েছে। তাই দোকান বন্ধ। পয়েন্টের পানি কমছে না।

২০২২ সালের বন্যার কথা মনে হচ্ছে, পানি না কমলে আমাদের গত বন্যার মতো কষ্ট ও দুর্ভোগ পোহাতে হবে। দোকান বন্ধ রাখলে পরিবার চলবে কীভাবে সে চিন্তাও মাথায় ঘুরছে। নগরীর উপশহর পয়েন্টে ভ্যানচালক সুমন মিয়া বলেন, মঙ্গলবার থেকে তিনি উপশহর এলাকায় ভ্যান চালিয়ে মানুষকে আসা-নেয়া করছেন। পাড়ার সড়ক বুঝে ভাড়া আগে কথা বলে ঠিক করে নেন। গতকাল ভালো ইনকাম করেছি; আশা করছি আজও ভালো হবে। উপশহরের কোনো গলির ভিতরে কোমর পানি রয়েছে। একই এলাকার ডি ব্লকের বাসিন্দা রুবেল আহমদ জানান, তাদের তিনতলা বাসার নিচতলায় হাঁটুর উপরে পানি রয়েছে। তাই নিচতলার বাসিন্দারা চলে গেছেন। ঈদের দিন সকাল থেকে বাসায় পানি উঠেছে। ময়লা পানি মাড়িয়ে চলাচল করতে হচ্ছে কয়েক দিন ধরে। কী আর করা। ২০২২ সালের বন্যার পর যদি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হতো তাহলে পাড়ার বাসিন্দাদের আবার দুর্ভোগ-ভোগান্তি পড়তে হতো না। মেন্দিবাগ পয়েন্টে ভ্যান চালক কামাল মিয়া বলেন, পয়েন্ট থেকে মেন্দিবাগ মসজিদ পর্যন্ত পানি রয়েছে। আমি ভ্যানে মানুষের এই জায়গা পার করে দিচ্ছি গতকাল থেকে। প্রতিজনের কাছ থেকে ১০ টাকা করে ভাড়া নিচ্ছি। নগরীর যতরপুর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল খালেক (৫৫) বলেন, আমাদের পাড়ায় ঈদের দিন সকাল থেকে পানি রয়েছে। আমি এই এলাকায় ভাড়া থাকি, আমি দুই তলার থাকার কারণে সমস্যা হয়নি। তবে আমাদের বিল্ডিংয়ের নিচতলার ভাড়াটিয়ারা আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গেছেন। পানির কারণে আমাদের ঈদের আনন্দ হয়নি। এই পাড়ায় কিছুদিন পরপর পানি উঠার করণে রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে সমস্যা হয়। একই এলাকার বেগম জাহান (৫০) হাঁটুর উপরে পানি মাড়িয়ে সোবাহানীঘাট পয়েন্টে এসেছেন। তার ভাষ্য, বাসার ভিতরে হাঁটু সমান পানি আজ তিন দিন ধরে। রোববার ভোরে পানি ঢুকে ভিজে নষ্ট হয়েছে বাসার জিনিসপত্র। এসব জিনিসপত্রসহ বাসার লোকজন খাটের উপর বসে রাত-দিন কাটাচ্ছে।

পানি না কমলে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এই ভোগান্তি আর শরীরে মানে না। পানি কমার কোনো লক্ষণও দেখছি না। ময়লা পানি দিয়ে চলাচল করলে হাত-পা চুলকায়, কী আর করা, চলাচল না করেও পারা যায় না। বাসার উপরতলায় রান্না হচ্ছে। তবে বিশুদ্ধ পানির জন্য বাইরে আসতে হয়; ভিজে নিতে হয় পানি। ঈদের দিন থেকে এভাবেই চলছে।

সোবাহানীঘাটের বাসিন্দা ও নগরীর দি এইডেড স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র চয়ন দাস জানায়, ঈদের দিন সকাল থেকে তাদের বাসায় পানি প্রবেশ করে। বর্তমানে বাসায় কোমর পানি রয়েছে। পরিবারের পাঁচ সদস্য পাশের বাসার দোতলায় গিয়ে উঠেছে ঈদের দিন। তাদের পাড়ার আরো অনেকে অন্য জায়গায় চলে গেছে।

নগরীর বেতেরবাজার এলাকার বাসিন্দা পারভেজ আহমদ বলেন, সোমবার দুপুর থেকে বাসায় পানি উঠেছে। বর্তমানে বাসার ভিতরে হাঁটুপানি। পরিবারের সবাইকে নিয়ে খাটের উপর বসে আছি। বুধবার পর্যন্ত কোনো সহায়তা পাইনি, ঘরের থাকা খাবার চলছে। বুধবার আরো পানি বেড়েছে, মঙ্গলবার একটু কমেছিল। আমাদের পুরো পাড়াতে পানি রয়েছে। আর আমাদের পাশের লামাপাড়ার বাসার বাড়িতে কোমর পানি রয়েছে। এ হচ্ছে আমাদের অবস্থা।

বেড়েছে পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা: সিলেট জেলা প্রশাসন জানায়, বন্যাদুর্গত এলাকার ১৭ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। আগামী তিন দিন ভারি বর্ষণের পূর্বাভাস রয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। মঙ্গলবার পর্যন্ত মহানগরের ২১টি ওয়ার্ড ও জেলার ১৩টি উপজেলার ১১৬টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৩২৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

এতে ৬ লাখ ৭৫ হাজার ৯৩৭ জন বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সিলেট মহানগরে অর্ধলাখ মানুষ পানিবন্দী। আর জেলা ও নগরী মিলিয়ে ৬২৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে; এর মধ্যে মহানগরে ৮০টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১৭ হাজার ২৮৫ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।

বিপৎসীমার উপরে নদ-নদীর পানি: পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবোর তথ্য মতে, সিলেটের কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশীদ পয়েন্টে মঙ্গলবার ১৫ দশমিক ৮৭ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল; যা বিপৎসীমার ৪৭ সেন্টিমিটার উপরে ছিল। বুধবার সকাল ৬টায় এক পয়েন্ট কমে বিপৎসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকাল ৯টায়ও অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে এই নদীর পানি ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে মঙ্গলবারের তুলনায় বুধবার আরও বেড়েছে; মঙ্গলবার পানি বিপৎসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বুধবার সকাল ৬টায় তা বেড়ে বিপৎসীমার ৯২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকাল ৯টার প্রতিবেদনে অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। মঙ্গলবার সুরমার পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বুধবার সকালে তা কমে বিপৎসীমার ৯৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকাল ৯টায় আরও দুই পয়েন্ট কমে ৯১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

তবে সুরমা নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে মঙ্গলবারের চেয়ে আজ সকালে আরও বেড়েছে। মঙ্গলবার এই পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বুধবার সকালে তা বেড়ে বিপৎসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকাল ৯টায় এক পয়েন্ট কমে বিপৎসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সারি-গোয়াইন নদীর সারিঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ০ দশমিক ৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

হবিগঞ্জে বাঁধে ভাঙন: হবিগঞ্জের খোয়াই, কুশিয়ারা ও কালনী-কুশিয়ারাসহ সব নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সদর উপজেলার জালালাবাদ গ্রামে খোয়াই নদীর তীররক্ষা বাঁধ ভেঙেছে। কুশিয়ারা নদীর তীররক্ষা বাঁধ উপচে নবীগঞ্জ উপজেলার ১০-১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। টানা বর্ষণে হবিগঞ্জ শহরের বেশ কিছু এলাকা ডুবে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, সার্কিট হাউস, অনন্তপুর, মাহমুদাবাদ, শ্যামলী, চৌধুরী বাজারসহ অনেক এলাকার লোকজন পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা করছেন জেলাবাসী।

হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ বলেন, বৃষ্টির পাশাপাশি ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে খোয়াই, কুশিয়ারা ও কালনী-কুশিয়ারা, সুতাং, করাঙ্গী নদীসহ হাওরে পানি বাড়ছে।

তিনি বলেন, বুধবার সকাল ৯টায় খোয়াই নদীর পানি চুনারুঘাটের বাল্লা সীমান্তে বিপৎসীমার ১৩১ সেন্টিমিটার, শায়েস্তাগঞ্জে ২১ সেন্টিমিটার এবং হবিগঞ্জ শহরের মাছুলিয়া পয়েন্টে ৭৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদী শেরপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার এবং মার্কুলী পয়েন্টে ২১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কালনী কুশিয়ারা নদী আজমিরীগঞ্জে ৩১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবার জেলায় ১১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে জানিয়ে শামীম হাসনাইন মাহমুদ বলেন, বুধবারও প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। ভারত থেকেও পানি আসছে বিপুল গতিতে। নদীর তীররক্ষা বাঁধে ভাঙন রোধে ৪ হাজার জিও ব্যাগ ও ১২ হাজার সিনথেটিক ব্যাগ মজুত করা হয়েছে। তবে বেলা ১টার দিকে খোয়াই নদীর বাল্লা পয়েন্টে পানি কমতে শুরু করেছে।

তিনি বলেন, শহরের গরুর বাজারের পরের অংশটিকে আমরা বলি ফসল রক্ষা বাঁধ। যদি বর্ষা মৌসুমে এসব বাঁধ না ভাঙে, শহররক্ষা বাঁধের দুর্বল অংশ ভেঙে পানি শহরে প্রবেশ করতে পারে। তাই শহরকে রক্ষার স্বার্থেই আসলে এসব অংশের ভাঙন দিয়ে পানি ছাড়তে হয়। আর তাছাড়া এখন আসলে হাওরে পানিও প্রয়োজন। নদীর পানি ভাটিতে হাওরে প্রবেশ করবে এটিই স্বাভাবিক। এসব ভাঙন আবার ফসল রক্ষার জন্য বর্ষার পর সংস্কার করা হবে। এটি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এদিকে, নবীগঞ্জ উপজেলার দীঘলবাক এলাকায় কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে কুশিয়ারা ডাইক উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে আহমদপুর, দুর্গাপুর, কুমার কাদা, পাহারপুর গ্রাম। লোকজন বালি ভর্তি বস্তা ফেলে পানি আটকানোর চেষ্টা করছেন। হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক জিলুফা সুলতানা বলেন, সম্ভাব্য বন্যা মোকাবিলায় ১৭১ টন চাল, ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ও ৭৮ বান্ডিল টিন মজুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও ৪২০ টন চাল জেলার ৯টি উপজেলায় পাঠানো হয়েছে। জেলায় এ পর্যন্ত ৮৮টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে; প্রয়োজনে আরও আশ্রয়কেন্দ্র বাড়ানো হবে বলে জানান তিনি।

টেকনাফে হাজারো মানুষ পানিবন্দী, পাহাড়ে মাইকিং: টানা ভারী বর্ষণে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় ছয় হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি-চিংড়ি ঘেরও। প্রাণহানি রোধে পাহাড়ে বসবাসকারীদের সরে যেতে মাইকিং করছে উপজেলা প্রশাসন। মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে গতকাল বুধবার সকাল পর্যন্ত ভারী বর্ষণের কারণে পাহাড় ধসের ঝুঁকিপূর্ণ বাড়ায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে।

জানা গেছে, উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজার, ওয়াব্রাং, চৌধুরীপাড়া, রঙ্গিখালী লামারপাড়া, চৌধুরীপাড়া, সাবরাং ইউনিয়নের পতেআলীপাড়া, বাহারছাড়াপাড়া, কুড়া বুইজ্জ্যাপাড়া, মুন্ডার ডেইলপাড়া গ্রামে বসবাসকারী আড়াই হাজার পরিবারের পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি টেকনাফ পৌরসভার ১২টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে ২০ হাজার মানুষ। ভারী বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে নতুন করে প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। পুরাতন পল্লানপাড়া পাহাড়ের তীরে বসবাসকারী মো. জোবাইর বলেন, ‘টানা বৃষ্টির কারণে ভয়ে আছি। এ সময়ে নির্ঘুম রাত কাটে। অন্য সময় তেমন একটা ভয় কাজ করে না। তাছাড়া আজ দুপুর থেকে এখান থেকে সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে।’ ভারী বর্ষণের পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন রঙ্গিখালী লামারপাড়ার বাসিন্দার নুর বাহার। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে পানি ঢুকেছে, ফলে ঘরের সব কিছু পানিতে তলিয়ে গেছে। সকাল থেকে শুধু মুড়ি খেয়ে দিন পার করছি। কেউ আমাদের খোঁজ নিতে আসেনি। আমাদের আশপাশের ৩৫টি পরিবার রয়েছে। সবার ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। মূলত স্লুইচ গেটের কারণে আমরা সবাই পানিবন্দী।’

হ্নীলা বাসিন্দা মোহাম্মদ শেখ রাসেল বলেন, ‘ভারী বৃষ্টিতে আমাদের অনেক গ্রাম তলিয়ে গেছে। এতে হাজারো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এসব মানুষের কষ্টের শেষ নেই। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগে থেকে কোনো সতর্ক বার্তা দেয়া হয়নি ভারী বৃষ্টির বিষয়ে। হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, ভারী বর্ষণে আমার এলাকার চারটি গ্রামের তিন হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। মূলত সীমান্ত সড়কের স্লুইচ গেইট থেকে বৃষ্টির পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে বের হতে না পারায় এসব এলাকা মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। আমরা তাদের খোঁজখবর নিচ্ছি।’ টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, ‘ভারী বর্ষণে কয়েকটি গ্রামে মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। আমরা তাদের খোঁজখবর নিচ্ছি। পাশাপাশি অতিভারী বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধসের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সকাল থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের অন্যত্র সরে যেতে বলা হচ্ছে। তারা আশ্রয়কেন্দ্র চলে গেলে পাহাড় ধসে প্রাণহানি থেকে রক্ষা পাবে। পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’

বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েন: সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার সিলেটে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে বলে গতকাল বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সিলেট সিটি করপোরেশনের অনুরোধে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের নির্দেশনায় ‘ইন এইড টু দ্য সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় সিলেটে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ সুরমা বড়ইকান্দি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র রক্ষায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এই বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রটি থেকে সিলেট রেলওয়ে স্টেশন, সিলেট শহরের পার্শ্ববর্তী বরইকান্দি, কামালবাজার, মাসুকগঞ্জ, বিসিক, লালাবাজার, শিববাড়ী ও কদমতলীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালসহ সংলগ্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এসব এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতে সেনাসদস্যরা কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানায় আইএসপিআর। যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় ‘ইন এইড টু দ্য সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় অসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করে আসছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ