ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ২৭ জিলহজ ১৪৪৫

প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় কলাতলীর ইসি এলাকায় অবৈধ ভবন নির্মাণের হিড়িক

প্রকাশনার সময়: ০৬ জুন ২০২৪, ১৭:০৫

উচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করে কক্সবাজার শহরের পর্যটক জোনের কলাতলীতে একের পর এক অবৈধ ভবন নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। পর্যটন উন্নয়নের দোহাই দিয়ে ইট-পাথরের গিঞ্জি শহরে পরিণত করছে একদল অর্থলোভী। ভবনের পর ভবন করতে ইকোলুজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) আইনও অমান্য করা হচ্ছে।

কক্সবাজার সৈকত থেকে উপরে ৩০০ মিটারে নতুন কোন স্থাপনা নির্মাণে ২০১৮ সালে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ভবন তৈরীতে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) ও জেলা প্রশাসন এবং অন্য প্রতিষ্ঠানের সঠিক অনুমতিও তোয়াক্কা করছেন না অনেক লোভী ব্যবসায়ী।

সূত্র মতে, পরিবেশগত বিবেচনায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে টেকনাফ সমুদ্র সৈকতের ১০ হাজার ৪৬৫ হেক্টর এলাকার প্রাণ বৈচিত্র্য, নির্মল জলরাশি এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় সরকার ১৯৯৯ সালে এ এলাকাকে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। এ নির্দেশনা মতে, কক্সবাজার পৌরসভার নাজিরারটেক থেকে টেকনাফের বদর মোকাম পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত, সৈকতের ঝাউ গাছসমৃদ্ধ ৩০০ মিটার উন্নয়ন নিষিদ্ধ ও ৫০০ মিটার সংরক্ষিত এলাকা। এ এলাকায় সব ধরনের স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণ নিষিদ্ধ।

লাবণী পয়েন্টে ২০১৭ সালে সার্কিট হাউজ নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে ১০ তলা ভবন তৈরির সিদ্ধান্তে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ থেকে ছাড়পত্রও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ইসিএ-তে এমন কাণ্ড হচ্ছে দেখে সেসময় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা এক রীটের বিপরীতে ‘ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান ফর কক্সবাজার টাউন অ্যান্ড সি আপ টু টেকনাফ’ মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী জোয়ার ভাটার মধ্যবর্তী লাইন থেকে পৌরসভার প্রথম ৩০০ মিটার ‘নো ডেভেলপমেন্ট জোন’ উল্লেখ করে এ এলাকায় কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না বলে নির্দেশনা দেয় উচ্চ আদালত।

এরপর ইসিএ হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় পূর্বে বরাদ্দ পেলেও স্থাপণা নির্মাণ না হওয়া অর্ধশতাধিক প্লটের বরাদ্দ বাতিলের আবেদন করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। এর প্রেক্ষিতে সেসব বাতিলও করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (কউক) সৈকত হতে ৩০০ মিটারে কোন স্থাপনা নির্মাণ থেকে বিরত থাকতে প্রচারণা চালায়।

এরপর কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্টে কোন নতুন স্থাপনা উঠার তেমন নজির না থাকলেও চলতি বছরের শুরু হতে এসব এলাকার একাধিক প্লটে দেদারসে নির্মাণ কাজ চলছে। প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় গত মাস দেড়েক ধরে কলতলীর ডলফিন মোডে ৪টি, মেরিনড্রাইভ সড়কের কলাতলী অংশে বেলী হ্যচারীর সামনে ১টি, ডিভাইন ইকো রিসোর্টের পাশে ৩টি ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সামনে একাধিক অনুমোদনহীন বহুতল ভবনের কাজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলছে।

এছাড়া কলাতলীর তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইস ও ডিভাইন ইকো-রিসোর্টের মাঝখানে খালি জমিতে দিন-রাত সমান তালে নির্মাণকাজ চালাচ্ছেন একদল শ্রমিক। সৈকতের বালিয়াড়ির দেড়-দু'শ ফুট দুরত্বে চারপাশে দেয়াল তোলে ডজনাধিক শ্রমিক বিরামহীন কাজ করছেন। নিচের ব্যাজমেন্ট পাকা করণের পর প্রথম তলা তৈরী করতে পিলার ও ছাদের লোহা বাঁধার কাজ চলছে দ্রুত। এ প্লটে ভবন তৈরীর কাজ হচ্ছে দেখে একই লাইনের খালি একাধিক প্লটে স্থাপনা নির্মাণের লক্ষ্যে মাটি ভরাটের কাজ চলানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে ইসিএ রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মুখথুবড়ে পড়ছে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা।

এদিকে গত কয়েকদিন আগে অভিযান চালিয়ে ওই ভবনের কাজ বন্ধ করে দেন জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট (এডিম) মো. ইয়ামিন হোসেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার (৬ জুন) সকাল থেকে পুরোদমে আবারও কাজ করতে দেখা গেছে।

যে প্লটে নির্মাণ কাজ চলছে সেই জমির মালিকের নাম বলতে নারাজ শ্রমিকরা। কাজ তদারক করা প্রকৌশলী নুরুজ্জামান বলেন, কাজের সব কাগজপত্র প্রকল্পের প্রধান তদারককারি প্রকৌশলী মিজানের কাছে। এসব দেখাতে কক্সবাজার শহরের লালদিঘীর উত্তরপাড়স্থ তার (প্রকৌশলী মিজানের) অফিসে নিয়ে যান তিনি। কাজের বিপরীতে যে কাগজ দেখান তা ২০১৫ সালে জেলা প্রশাসন ও ২০১৬ সালে গণপূর্তের নির্বাহি প্রকৌশলীর স্বাক্ষরে অনুমোদন পাওয়ার প্লান। নিয়মমতে কাজ শুরু না করায় আর ২০১৬ সালের শেষ দিকে স্বতন্ত্র ভাবে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) কার্যক্রম শুরুর পর আগের অনুমোদনে ভবন তোলা সম্ভব কিনা- এমন প্রশ্নে, প্রকৌশলী মিজান বলেন- আমরা কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউকের) অথরাইজ অফিসারের সঙ্গে কথা বলে কাজ করছি। প্লটের দেয়ালে লেখা রয়েছে, জমির মালিক এলিগেন্স ডেভেলপমেন্ট প্রপার্টিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব এমদাদ উল্লাহ। সেখানে দেয়া মোবাইলে নাম্বারে তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথমে অনুমতি সাপেক্ষে কাজ করছেন বলে দাবি করলেও ২০১৫ ও ২০১৬ সালের অনুমতি হিসেবে অটোবাতিল এবং সৈকতের বালিয়াড়ি হতে ৩০০ মিটারে কোন স্থাপণা নির্মাণে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেন, আমি শুরুতে কিছু কাজ করেছিলাম। পরে আর্থিক অসঙ্গতির কারণে কাজ বন্ধ ছিল-এখন আবার করা হচ্ছে। আমার জায়গা আদালতের নিষেধাজ্ঞায় পড়েনি।

কিন্তু নির্মাণ শ্রমিকরা গত একমাস ধরে বেইজ খুঁড়ে নতুন নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, এমনটি বলার পর এমদাদ উল্লাহ বলেন, আমরা ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক ও কউকের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তাদের সঙ্গে প্রাথমিক কথা হয়েছে- দু'য়েকদিনের ভেতর কাজের পারমিশন ফাইনাল হয়ে যাবে উল্লেখ করে, কাজ এগিয়ে নিতে গণমাধ্যমকর্মীদের সহযোগিতা চান তিনি।

উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইসি এলাকায় বিনা বাধায় রাত-দিনে বহুতল ভবন নির্মাণ চলতে থাকায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠছে- অদৃশ্য কারণে কউকের কিছু দায়িত্বশীল বা জেলা প্রশাসনের কেউ নির্মাণ চালিয়ে নিতে সহায়তা দিচ্ছেন।

তবে, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, কক্সবাজারে এখন ভবন নির্মাণ করতে হলে কউকের পারমিশন ছাড়া অসম্ভব। আমরা কাউকে বেআইনী সহযোগিতা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। এ নামের (এমদাদ) কাউকে আমি চিনি না- ইসি এলাকায় ভবন নির্মাণ বিষয়ে কারো সঙ্গে আমার বৈঠক বা কথাও হয়নি।

তবে, কউক সচিব মো. আবুল হাসেম গণমাধ্যমকে বলেন, বিষয়টি চেয়ারম্যান স্যারের নলেজে আছে। তিনি যেভাবে নির্দেশনা দিবেন সেভাবে এগুনো হবে।

নয়াশতাব্দী/এনএইচ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ