দখল আর অব্যবস্থাপনার কারণে ভরাট হয়ে গেছে পানি নিষ্কাশের একমাত্র খাল। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই গাজীপুরের ভাওয়াল গড় ইউনিয়নের বানিয়াচালা গ্রামের বিস্তৃতি এলাকা জুড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিপাতে শত শত বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করছে। ডুবে যাচ্ছে রাস্তাঘাট। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি জমির ফসল। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন শিল্পকারখানায় পানি প্রবেশ করছে। এতে করে প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে।
পানি নিষ্কাশনের একমাত্র খালটি সংস্কারের জন্য জেলা প্রশাসক, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ বরাবর লিখিত আবেদন করেছেন এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ ও এলাকাবাসী। গত কয়েক বছর ধরে বারবার আবেদন করে এলেও কারও সাড়া মেলেনি। ফলে দিন দিন আরও নাজুক হয়ে পড়েছে খালটির অবস্থা। অতীতে যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন আরও বেহাল দশা খালটির। ফলে আগামী বর্ষা মৌসুম নিয়ে উদ্বিগ্ন ভুক্তভোগীরা।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পূর্ব বানিয়াচালা থেকে লবণদহ নদীতে পতিত হওয়া খালটি প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে কয়েক স্থান বেদখল হয়েছে। কিছু জায়গায় ময়লা ফেলার কারণে ভরাট হয়েছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডের পশ্চিম পাশে অবস্থিত আবুল কাশেমের নির্মাণাধীন ফ্যাক্টরির বর্জ্য ও মাটি দ্বারা খালটি ভরাট হয়ে গেছে। অন্যদিকে কালভাটির পূর্ব পাশে ময়লা ফেলার ফলে খালটি ভরাট হয়ে গেছে। এ ছাড়াও এ রাস্তার পশ্চিম পাশে প্যারাগন গ্রুপের সিমটেক্স লিমিটেডের ভিতর দিয়ে অবস্থিত ড্রেন ভরাট করে শুধু পাইপের মাধ্যমে পানির নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে করে পর্যাপ্ত পানি বের হতে পারছে না। ফলে বৃষ্টির সময় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
জলাবদ্ধতার কারণে জনজীবন ও কৃষিকাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এলাকায় অবস্থিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ক্ষতির বিষয়ে গত বছরের ৯ অক্টোবর জয়দেবপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়। জিডি করেন বিজি কালেকশন লিমিটেডের প্রশাসনিক কর্মকর্তা নাসিমুল হাসান কচি। জিডি থেকে জানা যায় ৫ অক্টোবর বৃষ্টিতে এলাকাটিতে ৩ থেকে ৪ ফুট পানি বৃদ্ধি পায়। ফলে শতভাগ রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাটির নিচ তলায় পানি প্রবেশ করে। মেশিনারাজিসহ বিপুল পরিমাপ কেমিক্যাল, সুতা, কাপড়, রপ্তানিযোগ্য তৈরি পোশাক ও অ্যাক্সেসরিজ নষ্ট হয়। এতে বিজি কালেকশন লিমিটেডের প্রায় ২০ কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতি হয়। শুধু বিজি কালেকশ নয়। বিজি কালেকশনের মতো কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানও ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
পানি নিষ্কাশন ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মহলকে অনুরোধ জানায় বিজি কালেকশন কর্তৃপক্ষ। ২০২২ সালের ২১ জুন গাজীপুর জেলা প্রশাসক, গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ভাওয়াল গড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, গাজীপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ সুপারকে লিখিতভাবে জানানো হয়। এছাড়া একই বছর ৪ জুলাই শ্রীপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল সহকারী পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত আবেদন করে। কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করায় পুনরায় চলতি বছর ২০ জানুয়ারি গাজীপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ২২ জানুয়ারি গাজীপুর জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা ফিরোজ বলেন, এখানে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না রেখে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যার কারণে খালে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও যতটুকু ছিল তাও বর্জ্য ও আবর্জনা ফেলে বন্ধ করে ফেলেছে। ফলে ঘণ্টা খানেক বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। বাড়ি-ঘরে পানি উঠে যায়, জমির ফসল নষ্ট হয়, মাছ চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা বিভিন্ন সময়ে জেলা প্রশাসক, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছি। তবে স্থায়ীভাবে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উদ্যোগ কেউ গ্রহণ করেনি।
বিজি শিল্প কারখানা অডিট ও একাউন্টস বিভাগের এজিএম মো. ইনামুল হক বলেন, বৃষ্টির পানি বের হতে না পেরে জলাবদ্ধতা ডুবে যায় এলাকা। গত এপ্রিল মাসের বৃষ্টিতে আমাদের কারখানাসহ আশপাশের পুরো এলাকা তলিয়ে যায়। তিনি জানান, এলাকার একমাত্র পানি নিষ্কাশনের খালটির মুখে মহাসড়কের কালভার্টের নিচে ময়লা ফেলে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। গত দুই বছরে সিটি করপোরেশন থেকে গাড়ি এনে নিজস্ব উদ্যোগে কয়েকবার পরিষ্কার করা হয়েছে। প্রতিবার ৪-৫ লাখ খরচ করতে হয়। কিন্তু পরিষ্কারের পর আবারও ময়লা ফেলা হয়। সিটি করপোরেশন, গাজীপুরের ডিসিসহ বিভিন্ন দফতরে চিঠি দিয়েও সুরাহা পায়নি। বানিয়াচালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন সরকার বলেন, এলাকার লোকজন নিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে খালটি দুবার পরিষ্কার করেছি। সেখানে পাহারা বসানো হয়েছে। কিন্তু এরপরও ভোর রাতে বিভিন্ন কোম্পানি ট্রাকে করে ময়লা এনে ফেলে চলে যায়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, হাইওয়ে পুলিশ চেষ্টা করছে। কোম্পানি ময়লা ও জলাবদ্ধতার যন্ত্রণায় এলাকার মানুষজন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
গাজীপুরের সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল হক বলেন, আমি এখনো চিঠি পায়নি। চিঠি পেলে প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেয়া হবে। যদিও তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছে বিজি কারখানার কর্তৃপক্ষ।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতেহ মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, লিখিত অভিযোগের চিঠি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে পাঠানো হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ সরেজমিন পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকারি খাল হলে পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না। ব্যক্তিগতভাবে কেউ বাধা দিল এটাও বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এলাকাবাসীর জনদুর্ভোগ লাঘবে প্রয়োজন হলে প্রজেক্ট নিয়ে সমাধান করা হবে।
নয়া শতাব্দী/এসএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ