ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীতে টাকার অভাবে ছেলের চিকিৎসা না করিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে এনে মৃত্যুর অপেক্ষা করছিলেন স্বজনরা। অপেক্ষার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর মারা যায় কিশোর সুমন (১৬)।
শনিবার (২০ এপ্রিল) সকালে উপজেলার আমজানখোর ইউনিয়নের জুগিহার কাশিবাড়ী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
এর আগে শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) সকালে তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন স্বজনরা।
সুমন উপজেলার আমজানখোর ইউনিয়নের জুগিহার বাশবাড়ী গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে।
সরজমিনে গিয়ে জানা যায়, ৩ মাস পুর্বে কাজের সন্ধানে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় গিয়েছিলেন কিশোর সুমন সহ সীমান্তবর্তী ওই এলাকার ২৫-৩০ জন কিশোর। সেখানে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অধীনে চিওড়া সরকারি কলেজের ভবন নির্মাণে লেবার হিসেবে কাজ করছিলেন তারা। রমজানের শেষ দিকে ঈদের জন্য বাড়িতে চলে আসেন সবাই। যাতায়াতের খরচ বাঁচাতে বাড়িতে আসেননি কিশোর সুমন ও তার প্রতিবেশী জিলানী। সেখানে ঈদের পরদিন তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মারধরের শিকার হন সুমন। তারপর সুমনকে উদ্ধার করে ভর্তি করা হয় চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে কৌশলে এ্যাম্বুলেন্সে করে রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী খোকন মিয়া। রংপুরে ৫ দিন চিকিৎসার পর সুমনের স্বজনদের উন্নত চিকিৎসার জন্য স্থানীয় বিশেষায়িত একটি ক্লিনিকে পাঠান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে স্বজনরা টাকার অভাবে সেখানে চিকিৎসা না করে শুক্রবার নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন সুমনকে। শনিবার সকাল ১১টার দিকে মারা যায় সুমন।
সুমনের বাবা নজরুল ইসলাম জানান, উন্নত চিকিৎসার জন্য আইসিউতে ভর্তি করানোর পরামর্শ দিয়েছিল চিকিৎসক। সুমন মাথা, ঘাড়ে ও দুই হাতে প্রচুর আঘাত পেয়েছে। আইসিউতে প্রতিদিন ২৫ হাজার টাকা খরচ হবে। এত টাকা কোথা থেকে পাবো। এজন্য গতকাল ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে এসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছিলাম। অ্যাম্বুলেন্সে ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর গ্রামবাসী চাঁদা তুলে দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
সুমনের বাবা আরও জানান, ঠিাকাদার খোকন তাকে চিকিৎসা বাবদ ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এরপরে আর খোঁজ নেননি তিনি। আজ সকালে মৃত্যুর খবর জানালে দাফনের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
সুমনের সাথে কাজ করতে যাওয়া কয়েকজন যুবকের সাথে কথা বলে জানা যায়, একসঙ্গে কাজ করছিলাম আমরা। ঈদে সবাই বাড়িতে ফিরলেও জিলানী ও সুমন ফিরে নি। পরে শুনলাম মারামারি হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে সুমনকে। কেন, কি কারণে মারামারি হলো কেউ পরিস্কার বলতে পারেনি। তবে সুমনের মৃত্যুর পর থেকে জিলানীও গা ঢাকা দিয়েছে বলে জানায় তারা।
সুমনের প্রতিবেশী শরিফ ও তার স্বজনরা জানায়, ২৫ হাজার টাকা প্রতিদিন খরচ করতে হবে। এটা শোনার পর তাকে নিয়ে তার বাবা বাড়িতে চলে এসেছে। এছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। আজ রাতে খাওয়ার জন্য যে চাল, ডাল লাগবে; সেটার জন্য আমরা গ্রামবাসীর নিকট সহযোগিতা চাচ্ছি। অভাবে পড়ে সুমনের মৃত্যুর প্রহর গুনতে বাধ্য হয়েছে পরিবারটি।
পরিবারের কাছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নম্বর নিয়ে খোকনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
তবে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার স্থানীয় সাংবাদিক আকতারুজ্জামান মুঠোফোনে জানিয়েছেন, ওই ভবনের কাজ পেয়েছেন ফারুক আহমেদ মিয়াজী নামে এক ঠিকাদার। খোকন নামে কোনো ব্যক্তির অধীনে লেবারের কাজ করতে পারেন, তবে তিনি ঠিকাদার নয়।
তার কাছ থেকে নেওয়া ঠিকাদার ফারুক আহমেদ মিয়াজীর নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করলে তিনি ফোন ধরেননি।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মিঠু জানান, সবচেয়ে অসহায় পরিবার সুমনদের। কোনো মতে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে। চিকিৎসার জন্য টাকা নেই বলেই ছেলেকে নিয়ে এসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলো।
আমজানখোর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আকালু (ডংগা) বলেন, ঘটনাটি মর্মান্তিক। ছেলেটি চিকিৎসা করানো সামর্থ নেই তার বাবার। তাই বাধ্য হয়েছে এমন কাজ করতে। গ্রামবাসীর সহযোগিতায় সন্ধায় তাকে দাফন করা হবে।
জানতে চাইলে বালিয়াডাঙ্গী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ফিরোজ কবির বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা আমাদের কেউ অবগত করেনি। তবে পরিবারে কেউ অভিযোগ করলে পুলিশ আইনি সহায়তা দেবে।
নয়াশতাব্দী/টিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ