চট্টগ্রাম মহানগরে তীব্র তাপপ্রবাহে নাভিশ্বাস তৈরি হয়েছে। অতিরিক্ত গরমে নানা রোগব্যাধিতেও আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন বয়সী লোকজন। অতিরিক্ত তাপপ্রবাহের কারণে শিশুদের শরীর থেকে প্রচুর ঘাম বের হয়ে পানিশূন্যতা তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া টাইফয়েড, পানিবাহিত হেপাটাইটিস বা জন্ডিসের প্রবণতাও বাড়ছে।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের বেশিরভাগই চার থেকে পাঁচ বছর বা তারও কম এবং ৬০ বছরের বেশি বয়সি। এ ছাড়া শিশুদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। এতে চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে রোগীর চাপ। সর্দি, জ্বর-কাশি, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, চর্মরোগ ও ডায়রিয়ার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসছে দূর-দূরান্তের মানুষ। হাসপাতালের বহির্বিভাগেও রোগীর দীর্ঘসারি দেখা গেছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল এবং আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে দেখা যায়, চমেকে হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড রোগীর ভিড়ে ঠাসা। স্থান সংকুলান না হওয়ায় একেকটি শয্যায় দুই-তিনজন করে শিশুকে রেখেও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আবার মেঝেতেও বিছানা পেতে রাখা হয়েছে আক্রান্ত শিশুদের।
একদিকে অসুস্থতায় কাতরাচ্ছে এসব শিশু, তার ওপর ঘনঘন লোডশেডিং বাড়তি যন্ত্রণা হয়ে দেখা দিয়েছে। দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত এক ঘণ্টায় চমেক হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে অন্তত ছয়বার বিদ্যুৎ যেতে দেখা গেছে। এ সময় প্রচণ্ড গরমে শিশু ও তাদের অভিভাবকদের হাঁসফাস করতে দেখা গেছে।
সাতকানিয়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়ন থেকে ডায়রিয়া আক্রান্ত চার বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে গত ১৪ এপ্রিল চমেক হাসপাতালে এসেছেন জাহানারা বেগম। তিন দিন ধরে মেয়ে রোকসানাকে নিয়ে হাসপাতালে থাকলেও এখনো কোনো উন্নতি হয়নি। ডাক্তার আরও সাত দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, দুই মেয়ের মধ্যে রোকসানা ছোট। বড় মেয়ের বয়স ১২ বছর। তিন দিন ধরে মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে আছি। আমার শাশুড়িও আমার সঙ্গে আছেন। স্বামী চাকরি করায় আসতে পারেন না। মেয়ে অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। কথা বলতে পারছে না। ডাক্তার আরও সাত দিন থাকতে বলেছে। এরপরও উন্নতি না হলে মেয়েকে ঢাকায় বা চট্টগ্রামের ভালো কোনো প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করাবো।
একই শয্যায় চিকিৎসা নিচ্ছিল ডায়রিয়ায় আক্রান্ত সাত বছর বয়সী শিশু আবদুল ওয়াহাব। দুই দিন আগে ভর্তি হলেও সিট না পাওয়ায় মেঝেতে জায়গা করে নিয়েছে।
ওয়াহাবের বাবা আবদুল মালেক বলেন, সকাল থেকে ছেলের পাতলা পায়খানা শুরু হয়। স্যালাইন খাওয়ানোর পরেও থামছিল না। ২৪ ঘণ্টাতেও অবস্থার উন্নতি না হলে মেডিকেলে চলে আসি। এখানে পর্যাপ্ত সিট না থাকায় প্রথমে মেঝেতে দুই দিন কাটাতে হয়েছে। পরে একটি বেডে জায়গা হয়েছে। তাও আরেকজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হচ্ছে।
চমেক হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. এ কে এম রেজাউল করিম জানান, শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ৭০টি শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি ছিলেন ১৬৪ জন। তাদের বেশির ভাগই ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও খিঁচুনি রোগী। এ ছাড়া একই বিভাগের অধীনে আট নম্বর ওয়ার্ডে ২০ শয্যার বিপরীতে রোগী ছিলেন ৪০ জন। আর আইসিইউতে ভর্তি আছেন ১০ জন।
তিনি বলেন, গরমের সময় শিশুরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। কারণ তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। আমাদের ওয়ার্ডে বেশ কয়দিন ধরেই রোগীর চাপ বেড়েছে। আমরাও সর্বোচ্চটা দিয়ে সবাইকে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
শিশু ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা ডা. ফারহানা জেরিন জানান, হাসপাতালের সব শয্যাতেই রোগী রয়েছে। নতুন কোনো রোগী ভর্তি করা যাচ্ছে না। অধিকাংশ রোগীই ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। বুধবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩০টি নতুন শিশু ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ১৪ জন, থ্যালেসামিয়া ৯ জন, নিউমোনিয়া ছয়জন ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হয়েছে একজন।
জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার শামীম আহসান বলেন, এক সপ্তাহ ধরে অনেক গরম পড়ছে। শিশু ও বৃদ্ধদের অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার বেশি। হাসপাতালে চাপও বেড়েছে। শিশু ওয়ার্ডে স্বাভাবিক সময়েও চাপ থাকে। সবসময় সবাইকে সিট দেওয়া যায় না। এখন চাপ একটু বেশি। সবচেয়ে বেশি ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার রোগী।
চমেক হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডেও গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হওয়া ৪০ রোগীর মধ্যেই ২৮ জনই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। ওয়ার্ডের বাইরেও রোগীদের সেবা নিতে দেখা গেছে। স্বাভাবিক পরিমাণের চেয়ে বেশি শিশু রোগী ভর্তি আছে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালেও।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত ২৬২টি শিশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে এ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছে।
আর চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামে ১৬২ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে মীরসরাইয়ে ১৯ জন, সীতাকুন্ডে ১৬ জন, সন্ধীপে আটজন, ফটিকছড়িতে ১৪ জন, হাটহাজারীতে সাতজন, রাঙ্গুনিয়ায় ১২ জন, বোয়ালখালীতে ১৫ জন, আনোয়ারায় ১৩ জন, পটিয়ায় ১৬ জন, বাঁশখালীতে ১৯ জন, কর্ণফুলীতে দুজন, চন্দনাইশে ১১ জন, সাতকানিয়ায় ছয় ও লোহাগাড়ায় চারজন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন, যার মধ্যে ১২৫ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ