ঢাকা, রবিবার, ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১, ১১ রজব ১৪৪৬
শিশু ছোয়াদ অপহরণ

মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনায় গৃহকর্মীর কাজ নেন রোহিঙ্গা নারী

প্রকাশনার সময়: ৩১ মার্চ ২০২৪, ১৬:১২

অপহরণ আর মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা নিয়েই প্রবাসীর বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন রোহিঙ্গা নারী উম্মে সালমা। আর সেই সূত্র ধরেই ৯ মার্চ কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে অপহরণ করা হয়েছিল ৬ বছরের শিশু মাদরাসাছাত্র ছোয়াদ বিন আব্দুল্লাহকে। ২২ দিন পর শনিবার (৩০ মার্চ) কুমিল্লার লালমাই এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে শিশুটিকে।

রোববার (৩১ মার্চ) শিশুটি অবশেষে ফিরেছে তার মায়ের কাছে। আর একই ঘটনায় গত ২২ দিনে দফায় দফায় গ্রেপ্তার ১৭ জনের কাছে মিলেছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য। আর সেই তথ্য শুনে মনে হবে এটি একটি চলচ্চিত্রের কাহিনী।

রোববার দুপুরে টেকনাফ থানায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই অপহরণের বিস্তারিত বর্ণনা দেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উখিয়া সার্কেল) মোহাম্মদ রাসেল ও টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মুহাম্মদ ওসমান গণি।

অপহৃত শিশু ছোয়াদ বিন আব্দুল্লাহ টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের সৌদি প্রবাসী মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর ছেলে। সে পূর্ব পানখালী এলাকার আবু হুরাইরা (রাঃ) মাদরাসার প্রথম শ্রেণির ছাত্র। সংবাদ সম্মেলনে শিশুর মা নুরজাহান বেগমও উপস্থিত ছিলেন।

এ ঘটনায় কয়েক দফায় গ্রেপ্তার ১৭ জন হলেন, টেকনাফের মোচনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নাগু ডাকাতের ছেলে আনোয়ার সাদেক (২১), তার বাবা মৃত আবদুর শুক্কুরের ছেলে নাগু ডাকাত (৫৫), মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী লায়লা বেগম (৫৫), মোহাম্মদ খানের স্ত্রী উম্মে সালমা (২৪), নাগু ডাকাতের ভাই মোহাম্মদ হাশেম (২৭), সৈয়দুল হকের স্ত্রী খাতিজাতুল খোবরা (৩৫), নাগু ডাকাতের স্ত্রী আয়েশা বেগম (৩২), সাদেকের স্ত্রী হোসনে আরা (২০), নাগু ডাকাতের অপর ছেলে রনি (১২), কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিরপাড়ায় বসবাসকারি পুরাতন রোহিঙ্গা জাফর আলমের ছেলে নাসির আলম (২৮), মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়নের মাইস্যাঘোনা এলাকার মনছুর আলমের ছেলে সালামত উল্লাহ প্রকাশ সোনাইয়া (৪৫), একই ইউনিয়নের নয়াপাড়া এলাকার মৃত কালামিয়ার ছেলে জহির আহমেদ (৬৫), শামসুল আলমের ছেলে হাসমুল করিম তোহা (২০), সামিরাঘোনা এলাকার ফরিদুল আলমের ছেলে মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ (১৯), তার বাবা মৃত রহমত উল্লাহ ছেলে ফরিদুল আলম খান (৫২), সালামত উল্লাহর ছেলে মো. আমির হোসেন (২৪), শামসুল আলমের ছেলে তৌহিদুল ইসলাম তোহা (৩০)।

তারা সকলেই পরস্পর আত্মীয় এবং রোহিঙ্গা জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উখিয়া সার্কেল) মোহাম্মদ রাসেল জানান, আনোয়ার সাদেকই মূলত এই অপহরণ চক্রের প্রধান হিসেবে কাজ করে আসছে। পরিবারের সদস্য, আত্মীয়দের নিয়ে গঠিত অপহরণ চক্রের প্রধান সাদেকের পরিকল্পনায় উম্মে সালমা টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের সৌদি প্রবাসী মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ নিয়েছিলেন। যেখানে কিছু দিন কাজ করার পর ছেলে ছোয়াদ বিন আব্দুল্লাহর সাথে পরিচয় এবং সখ্যতা তৈরি করেন। এর কিছুদিন পর উম্মে সালমা চলে গিয়ে অপহরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।

এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ মার্চ অপহরণ করা হয় শিশু ছোয়াদ বিন আব্দুল্লাহকে জানিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, গত ৯ মার্চ দুপুরে ক্লাস শেষে মাদরাসা থেকে ফেরার পথে ছোয়াদকে দুর্ঘটনায় মায়ের মাথা ফেটে গেছে এবং হাসপাতালে মাকে দেখতে যাওয়ার কথা বলে ছোয়াদকে অটোরিকশায় তুলে অপহরণ করেন উম্মে সালমা। ওইদিন সন্ধ্যায় ভুক্তভোগী শিশুর মা নুরজাহান বেগম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে থানায় এজাহার দায়ের করেন। পুলিশ মামলাটি নথিভুক্ত করে তদন্ত শুরু করে।

পুলিশ ঘটনাস্থল ও আশপাশের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রাখে। ১০ মার্চ সন্ধ্যায় কক্সবাজার শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় অভিযান চালিয়ে অটোরিকশাসহ চালক নাসির উদ্দিনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

অটোরিকশা চালকের স্বীকারোক্তি মতে, গত ১২ মার্চ টেকনাফ উপজেলার মোচনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ঘটনায় জড়িত সংঘবদ্ধ অপহরণ চক্রের উম্মে সালমাসহ আরও ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য নিয়েই অপহরণকারী পুরো চক্রটিকে শনাক্ত করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদ রাসেল।

ওসি মুহাম্মদ ওসমান গণি জানান, এরপর থেকে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রাখে। অভিযানে এক-একজনকে গ্রেপ্তারের পর আরও তথ্য আসতে শুরু করে। এর মধ্যে শিশুর নুরজাহান বেগমকে ফোন করে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এমনকি মুক্তিপণ না দিলে শিশুটি হত্যা করার হুমকি প্রদান করে। মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে অপহৃত শিশুকে বিভিন্ন সময় নির্মমভাবে মারধর করে কান্নাকাটির শব্দ শোনায়। ফলে পুলিশ অভিযানের পাশাপাশি নানা কৌশলে এগিয়ে যেতে থাকে। অপহরণ চক্রের সদস্যরা শিশুটি নিয়ে একের পর এক স্থান পরিবর্তন শুরু করে।

ওসি জানান, টেকনাফ থেকে অপহরণের পর শিশুটিকে ঈদগাঁও এলাকায় রাখা হয়। ওখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়ার গহীন পাহাড়ে। যেখানে পুলিশ অভিযান টের পেয়ে শিশুটি নিয়ে যাওয়া হয় কুমিল্লার লালমাই এলাকার একটি ভাড়া বাসায়। এর মধ্যে মুক্তিপণের ৪ লাখ টাকা প্রদানের কৌশলে শনিবার দুপুরে কুমিল্লার লালমাই এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। এসময় মুক্তিপণের ৪ লাখ টাকা ফেরত আনা ছাড়াও অপহরণে ব্যবহৃত সিএনজি ও ৪টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আনোয়ার সাদেক, শাহীন, তোহা, নাগু ডাকাত, মধু, হোসনে আরা এবং তাদের পরিবারের সদ্যস্যরা অপহরণ চক্রের সক্রিয় সদস্য। এই অপহরণের ঘটনায় জড়িত অপহরণ চক্রের অন্যান্য সদস্যদের শনাক্ত করা হয়েছে এবং তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গ্রেপ্তার আসামিদের আদালতে প্রেরণ করা হচ্ছে।

২২ দিন পর শিশুকে ফেরত পেয়ে অপহৃত শিশুর মা নুরজাহান বেগম সন্তোষ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, অপহরণ যে কোনভাবেই বন্ধ হওয়া জরুরি। পুলিশকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

পুলিশের তথ্য বলছে, গত এক বছরে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১১৭ জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৫৯ জন স্থানীয় বাসিন্দা, বাকিরা রোহিঙ্গা নাগরিক। অপহরণের পরিবারের তথ্য বলছে, অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৫১ জন মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছে।

নয়া শতাব্দী/এসএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ