মিয়ানমারের সামরিক জান্তার মতো এবার আরাকান আর্মির সদস্যরাও রোহিঙ্গাদের নির্যাতন-নিপীড়ন শুরু করেছে। এ পরিস্থিতিতে নির্যাতন বন্ধ করতে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে মঙ্গলবার মিয়ানমারের বুচিডং শহরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে রোহিঙ্গারা। একই সঙ্গে এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তত ৩ লাখ রোহিঙ্গা পালানোর চেষ্টা করছেন। এরা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করছেন খোদ সরকারি দায়িত্বশীল সংস্থা।
মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সাথে যুদ্ধের শুরুতে রোহিঙ্গাদের সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন (আরএসও) সদস্যরা আরাকান আর্মির পক্ষে থাকলেও সম্প্রতি সংগঠনটিও বিপক্ষে গেছে। আরএসও সদস্যরা এখন উল্টো মিয়ানমারের সামরিক জান্তার হয়ে কাজ করছে। মিয়ানমারের অবস্থানরত রোহিঙ্গা, সীমান্ত বাণিজ্যে নিযুক্ত ব্যবসায়ী, মিয়ানমারের থেকে পাঠানো ভিডিও ও ছবি, বাংলাদেশের সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থার সাথে আলাপ করে এসব তথ্যের সত্যতা মিলেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিয়ানমারের মংডু শহর ঘিরে বর্তমানে কমপক্ষে ৩ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। যেখানের সিকদার পাড়া, দলিয়াপাড়া, কদিরবিল, নুরুল্যাহ পাড়া, বাগগুনা, থানাশো, সোজাপাড়া সহ আরও কয়েকটি গ্রাম ঘিরেই এসব রোহিঙ্গাদের বসবাস। যেসব রোহিঙ্গারা মংডু শহর ও তার আশে-পাশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য ঘের ও কৃষি কাজ করে জীবিকা পরিচালনা করে আসছিল। ২০১৭ সালের মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নির্যাতন নিপীড়নে বাংলাদেশে ১১ লাখ রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ওই সময়ও এসব গ্রাম থেকে রোহিঙ্গা ঘর ছেড়ে আসেননি।
মংডু শহরবর্তী সোজাপাড়ার রোহিঙ্গা মোহাম্মদ আনোয়ার জানিয়েছেন, গত ২০ দিন ধরে পরিস্থিতি খুব জটিল হয়ে উঠেছে। আরাকান আর্মির যোদ্ধারা রাখাইন রাজ্যের ৯৫ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এখন মংডু শহরের কিছু অংশ, বুচিডং শহরের কিছু অংশ, সিতওয়ে (আকিয়াব) মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের জান্তার সদস্যরা কয়েক দফায় রোহিঙ্গাদের সাথে বৈঠক করেছে। তারা রোহিঙ্গাদের সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়া এবং সেনা বাহিনীদের যোগ দিয়ে যুদ্ধ করার আহ্বায়ন জানিয়েছিল। কিন্তু এতে রোহিঙ্গারা সম্মতি প্রদান করেনি।
কিন্তু বৈঠকের বিষয়টি জানার পর আরাকান আর্মির সদস্যরা রোহিঙ্গাদের উপর ক্ষুব্দ হয়েছে মন্তব্য করে আনোয়ার জানিয়েছেন, আরাকান আর্মি এখন মিয়ানমারের জান্তার ভূমিকা নিয়েছে। ২০১৭ সালে জান্তাদের মতো আরাকান আর্মিও রোহিঙ্গাদের নির্যাতন চালাচ্ছে। রোহিঙ্গা নারীদের ঘর থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা পুরুষদের মারধর করা হচ্ছে। একই বর্ণনা এসেছে সিকদার পাড়ার মোহাম্মদ সেলিম নামের অপর এক রোহিঙ্গার কথায়ও।
তিনি জানান, বর্তমানে পরিস্থিতি খুব খারাপ। মিয়ানমারের জান্তার পক্ষে রোহিঙ্গাদের সাথে নমনীয় আচরণ করা হলেও আরাকান আর্মি উল্টো করছে। ফলে মংডু শহরের আশে-পাশের রোহিঙ্গারা পালানোর চেষ্টায় আছেন। নাফনদীর মিয়ানমার সীমান্তবর্তী মৎস্য ঘের, প্যারাবনের আশে পাশে অনেক রোহিঙ্গা এখন আশ্রয়ে রয়েছেন। যারা বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার দুপুরে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ করার দাবি ও যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানিয়ে বুচিডং শহরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে করা বিক্ষোভের ভিডিওতে রোহিঙ্গাদের নানা স্লোগানসহ আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করতেও দেখা গেছে।
বুচিডং এ অবস্থানরত আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা কর্মরত এক রাখাইন তরুণ হোয়াটস অ্যাপ বার্তায় বলেছেন, রোহিঙ্গারা বিক্ষোভে আরাকান আর্মির সদস্যরা রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ এবং পুরুষদের মারধর করে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছেন। বিক্ষোভের পর আরাকান আর্মি আরও ক্ষুব্দ হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। ফলে এ পরিস্থিতিতে আবারও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টায় সীমান্ত জড়ো হওয়ার কথা বলছেন সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোও।
গোয়েন্দা তথ্য বলছে, আরাকান আর্মি এখন রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ফলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। যার জের ধরে মঙ্গলবার ভোরে টেকনাফের হ্নীলা সীমান্তের নাফনদীর ওপারের লালদ্বীপ এলাকায় আরএসও সদস্যরা হামলা চালিয়েছে। যেখানে আরাকান আর্মির সাথে আরএসও সদস্যদের ঘণ্টাব্যাপী সংঘাত হয়। বর্তমানে লালদ্বীপটি আরএসও’র দখলে রয়েছে। যদিও মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সাথে যুদ্ধের শুরুতে রোহিঙ্গাদের এই সংগঠনটি আরাকান আর্মির পক্ষে ছিল।
রাখাইনের পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন, টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি গণমাধ্যমে বলেন, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে কঠোর নজরদারিতে আছে
নয়া শতাব্দী/এসএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ