চোখে ছিল পানি, তবু সিন্ধ হাসি দিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সকলের কাছ থেকে বিদায় নেন 'মোস্তফা ভাই'। যাকে ছেলের বয়সী শিক্ষার্থীও ভাই বলে সম্বোধন করেন। এ সময় তিনি নিজে কাঁদেন এবং সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরও কাঁদান।
এমন দৃশ্যের অবতারণা হয় কক্সবাজারের রামুর খিজারি উচ্চ বিদ্যালয়ের বিদায়ী স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (দপ্তরি) মোস্তফা কামালের অবসর জনিত বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। তিনি প্রায় ৪০ বছর ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন।
মায়া, মমতা ভালোবাসা আর আন্তরিকতায় একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর বিদায় অনুষ্ঠান হয়ে ওঠলো রাজকীয়। এ যেন এক বিরল দৃষ্টান্ত।
বুধবার (২০ মার্চ) দুপুরে বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শিক্ষক পরিষদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক নূরুল হোসাইন।
অতিথি ছিলেন, বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সাবেক প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) মো. সহিদুল্লাহ, অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক মো. আব্দুল হালিম, মো.বখতেয়ার আহম্মদ, প্রাক্তন ছাত্র এসএম জাফর ও সুনীল বড়ুয়া প্রমুখ।
আর গলায় ফুলের মালা পরিয়ে অনুষ্ঠানের মধ্যমনির আসন অলংকৃত করেন মোস্তফা কামাল। অনুষ্ঠানে মোস্তফা কামাল নিজে কাঁদলেন। আবার অনেক শিক্ষক, প্রাক্তন শিক্ষার্থীও আবেগাপ্লুত হয়ে মায়ার জলে চোখ ভিজিয়েছেন।
অনুষ্ঠানে সহকর্মী, প্রাক্তন শিক্ষার্থী অনেকে তার কর্মময় জীবনকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছেন, প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। উপহার সামগ্রী দিয়ে সম্মান জানিয়েছেন।
অনুষ্ঠানে সবাই কম-বেশি একটি কথাই বলেছেন, মোস্তফা কামাল একজন সৎ এবং ভালো মানুষ ছিলেন। ভালো আমানতকারী ছিলেন। যুগযুগ ধরে তিনি মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন। কাজের ক্ষেত্র যতোই ছোট হোক না কেন, সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করলে মানুষের অপার ভালোবাসা লাভ করা যায় মোস্তফা কামাল তাই প্রমাণ করলেন।
কয়েকশ শিক্ষার্থী ছাড়াও অনুষ্ঠানে প্রিয় সহকর্মীকে বিদায় জানাতে আরও উপস্থিত ছিলেন, বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মফিজুল ইসলাম, মো.আব্দুর রশিদ, মো.এনামুল হক, নাজনীন আকতার, শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম, অর্পিতা চৌধুরী, রুপম কুমার দাশ, অরুন দে, নিজাম উদ্দিন, ইমরুল কায়েস, মো. রমজান আলী, জজ বাহাদুর দে, নাসরীন নূর, শিপন বড়ুয়া, আমেনা আক্তার, মো. জসীম উদ্দিন ইয়াসমীন আকতার, মেজবাহ উদ্দিন, মো. খাইরুল প্রমুখ।
সবার একই ভাষ্য, একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর বিদায়েও ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার আবরণে রাজকীয় হতে পারে। তা তার নিজ কর্মগুণেই তিনি অর্জন করেছেন। সমাজের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী সেই মোস্তফা কামালেরা আজীবন বেঁচে থাকুক আমাদের সমাজে।
বিদ্যালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মফিজুল ইসলাম বলেন, একজন মানুষ ৪০টি বছর এই প্রতিষ্ঠানের জন্য শ্রম দিয়েছেন। তা চারটিখানি কথা নয়। এই বিদ্যালয় যতদিন থাকবে ততদিন মোস্তফা কামালের কর্মকে স্মরণ করবে রামুবাসী।
রামু খিজারী সরকারি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক নূরুল হোছাইন বলেন, ‘আমি এই স্কুলের ছাত্র ছিলাম তখনও তাকে মোস্তফা ভাই ডাকতাম, আর এখনও তাকে মোস্তফা ভাই ডাকি। ছাত্র-শিক্ষক, ছোট বড় সবার কাছে সমান জনপ্রিয় মোস্তফা ভাই এ কথা জানিয়ে এই শিক্ষক বলেন, আজকের অনুষ্ঠান প্রমাণ করে এই বিদ্যালয়ের জন্য কতটা নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন।
সাবেক প্রধান শিক্ষক মো. সহিদুল্লাহ বলেন, জীবনের বেশিরভাগ সময় মোস্তফা কামাল এই স্কুলের জন্য দিয়ে গেছেন। সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। রামুকে, রামুর মানুষকে ভালবেসে ফেলেছিলেন মোস্তফা কামাল। এই স্কুলের প্রতিটি ধুলিকণা মোস্তফার অবদানককে স্মরণ করবে। নিজ বাড়িতে গিয়ে তার অবসরকালীন সময় ভালো কাটুক এই প্রত্যাশা করি।
রামুর প্রবীণ শিক্ষক আব্দুল হালিম বলেন, একজন মানুষ কতটা ভালোবাসলে তার বিদায় অনুষ্ঠানে এ রকম আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সবই তার কর্মগুণে সম্ভব হয়েছে। মোস্তফা ছোট চাকরি করেছেন। কিন্তু তার অবদান রামুবাসী আজীবন মনে রাখবে।
নয়াশতাব্দী/এসএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ