নারীরা এখন নানা ক্ষেত্রে অবদান রাখছে । এভারেস্ট জয় করছে, পাইলট হয়ে বিমান চালাচ্ছে, যুদ্ধ ক্ষেত্রে যুদ্ধ করছে, ট্রেন চালাচ্ছে এবং সফলও হয়েছে । কিন্তু নারী হয়ে জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করে সফল হতে গেলে অনেক প্রতিবন্ধকতা জয় করতে হয়।
জীবন যুদ্ধে সংগ্রামী এক সফল নারী নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার বিলকিস বেগম। শুধু মাত্র দু-বেলা দু মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য তিনি ১২ বছর আগে চায়ের দোকানের মাধ্যমে সংগ্রাম শুরু করে শতভাগ সফলতা পেয়েছেন।
বিলকিস বেগম উপজেলার কাঁদীবাড়ি গ্রামের মানসিক প্রতিবন্ধী ইয়াকুব আলীর স্ত্রী। তিনি এখন বদলগাছী উপজেলা ডাংক বাংলোর মোড়ের চা দোকানি বিদ্যুতের মা নামে সকলের কাছে পরিচিত। চায়ের দোকান করে ইতোমধ্যে তিনি মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, ছেলেকে স্বাবলম্বী করে তাকেও বিয়ে দিয়েছেন। ২ লাখ ৬০ হাজার টাকায় ৫ শতক জমি কিনে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয়ে দুই রুম বিশিষ্ট ইটের ঘর তুলেছেন। সংসারে এসেছে স্বচ্ছলতা।
আজকের এই পরিচয়ের পিছনে আছে এক লম্বা ইতিহাস। প্রায় ১৪-১৫ বছর আগে স্বামী ইয়াকুব আলীর হঠাৎ ব্রেন স্ট্রোক করে, মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে যায় । নিজস্ব জমিজমা না থাকায় দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখতে থাকেন বিলকিছ বেগম। এরই মধ্যে স্বামীর চিকিৎসার খরচ যোগাতে শেষ সম্বল বাড়ির জমি টুকুও বিক্রি করে আশ্রয় নেন অন্যের জমিতে। সংসারে পরিশ্রমী কেউ না থাকায় অনাহারে অর্ধাহারে কাটতে থাকে দিন।
বাধ্য হয়ে এক সময় দশ বছরের ছেলে বিদ্যুৎকে অন্যের চায়ের দোকানে তিন বেলা খাওয়াসহ সামান্য কিছু বেতনে কাজে রাখেন । কিন্তু এতে কি সংসার চলে, ফলে এক সময় তিনি নিজেই নামেন সংগ্রামের পথে । হিতাকাংঙ্ক্ষী দু-এক জনের পরামর্শে এনজিও থেকে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে উপজেলা সামনে ফুটপাতের উপর শুরু করেন চায়ের দোকান। ছেলেকেও সহযোগিতার জন্য কাজ থেকে ছাড়িয়ে নেয়।
দোকানটি উপজেলা শহরের ব্যস্ততম এলাকায় হওয়ায় অল্প দিনেই জনপ্রিয়তা পায় সকলের কাছে। কোনো মতে তিন বেলা খেয়ে আস্তে আস্তে টাকা জমিয়ে পুঁজি বাড়িয়ে চায়ের সাথে যোগ দেয় বিস্কুট, কেকসহ বিভিন্ন হালকা নাস্তার আইটেম। গ্রাহকের চাহিদার কথা বিবেচনা করে যোগ করে বুট মুড়ি মাখা, কলা-রুটি, সিঙ্গারা, লাড্ডু, সন্দেশ ও সিগারেট।
এতে আরও জনপ্রিয়তা বাড়ে বিলকিস বেগমের চায়ের দোকানের। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা হতে সরকারি অফিসগুলোতে কাজের জন্য আসা মানুষগুলো কাজের ফাঁকে একটু অবসরই যেন বিলকিস বেগমের চায়ের দোকান। সেখানে গেলে এককাপ চাও হয় সাথে স্বল্প মূল্যে ক্ষুধা নিবারণের জন্য আছে মুড়ি মাখা, বিস্কুট, রুটি কলা ইত্যাদি।
তবে এর মধ্যে বাধাও এসেছে অনেক। ফুটপাত দখল মুক্ত করায় বিপাকে পড়েন তিনি । কিন্তু স্থানীয়দের সহযোগিতায় আর তৎকালীন চেয়ারম্যান সাহেবের কৃপায় ইউপি পরিষদের সামনে একটু জায়গা দেওয়া হয়। সেখানে থাকেন বেশ কিছু দিন। ইউপি পরিষদের সামনে চায়ের দোকান বিষয়টি খারাপ দেখালে সেখানেও আর থাকা হয় না তার। পরে পরিষদের পিছনে ফাঁকা জায়গায় স্থান দেওয়া হয়েছে তাকে। এখন সেখানেই একমাত্র ছেলে বিদ্যুৎকে নিয়ে চলছে তার স্বপ্ন পূরণের লড়াই।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আইয়ুব মীর জানান, বিলকিস বেগমের স্বামী একজন মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় সংসারে রোজগারের কেউ ছিল না । বাধ্য হয়ে প্রায় এক যুগ আগে বিলকিস বেগম তার ১০ বছরের ছেলে বিদ্যুৎকে নিয়ে এই চায়ের দোকান শুরু করেন। এক বছর আগে তার অসুস্থ স্বামী মারা যান। এই ব্যবসা করে তিনি ছেলে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, জমি কিনে বাড়ি করেছে। নিঃসন্দেহে তিনি একজন সফল নারী।
নিয়মিত চা খেতে আসা তরুণ প্রজন্মের কয়েক জনের সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের, এসময় জনি আলম, দর্পণ, উজ্জ্বল, শ্যামল, শাহিন, টগর, সাব্বির, পলাশ, সুমন, নয়ন, সালমান জানান, বিলকিস নামের এই নারী চা বিক্রেতা দীর্ঘ দিন ধরে উপজেলার ডাংক বাংলোর মোড়ে চা বিক্রি করেন। তার চায়ের স্বাদ দারুণ এবং তার ব্যবহার ও ভালো। আমরা সময় পাইলেই এই বিদ্যুৎ এর মায়ের দোকানে চা খেতে আসি।
উপজেলার কোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীনুর ইসলাম স্বপন বলেন, আমি দু'বার ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়েছি, কোলা ইউপির চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি, আমি একজন জনপ্রতিনিধি হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে এই উপজেলাতে বিভিন্ন কাজে আসি। আমি উপজেলাতে আসলেই এই দোকানে হাল্কা নাস্তা ও চা খেতে আসি। আমি সেই থেকেই দেখছি ছোট্র এই বাচ্চাটিকে নিয়ে তিনি চা বিক্রি করছেন। তার ব্যবহার ও তার তৈরি চা দুটোই আমার ভাল লাগে তাই অন্য দোকানের চেয়ে এই বিলকিস এর চায়ের দোকানে সময় পেলেই এসে এখানে চা খাই।
সংগ্রামী নারী বিলকিস বেগম বলেন, চা বিক্রি করে দিনে ১৫শ হতে দুই হাজার টাকার মতো বিক্রি হয় এতে লাভ থাকে ৩০০ হতে ৫০০ টাকা। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি নাতি-নাতনি হয়েছে এবং ছেলেকেও বিয়ে দিলাম এই ব্যবসা করেই। জমি কিনে থাকার দুইটা ঘরও করেছি এই ব্যবসা করে একটু একটু করে জমিয়ে। দোয়া করবেন আগামী দিন যেন এভাবেই কাটাতে পারি।
বদলগাছী সদর ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, বিলকিস এক জন পরিশ্রমী নারী।
নয়া শতাব্দী/এসএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ