ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নে অভিযুক্ত কক্সবাজারের রামু সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক মোহাম্মদ হোছাইনের বিরুদ্ধে এবার নিজেকে বাঁচাতে অপকৌশলের আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের পর নিজেকে বাঁচাতে এবং নির্দোষ প্রমাণ করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন তিনি।
এর আগে গত ৭ মার্চ রামু সরকারি কলেজে জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করে ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক কাজ করতে গিয়ে কক্সবাজার সৈকতের কবিতা চত্বরে ধরা পড়েন রামু সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক মোহাম্মদ হোছাইন। এ সময় ভুক্তভোগী ছাত্রীর কাছ থেকে খবর পেয়ে সহপাঠীরা ওই শিক্ষককে হাতেনাতে ধরে উত্তম মধ্যম দিয়ে আদালতপাড়ায় নিয়ে আসেন।
সেখানে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ রেজাউল করিম কাজলের চেম্বারে ৩০০ টাকার ননজুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পান হোছাইন। এর দুদিন পর গত ১০ মার্চ সকালে এ ঘটনার প্রতিবাদে এবং শিক্ষক হোছাইনের অপসারণ ও শাস্তির দাবিতে কলেজ ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থীরা। এর পরদিন কলেজ কর্তৃপক্ষ ঘটনার তদন্তে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি করে। বর্তমানে বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।
তবে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, ‘এ আপসনামায় অসংগতি রয়েছে। এটি অভিযুক্ত শিক্ষককে নির্দোষ প্রমাণ করে না।’ নিজেকে বাঁচাতে ভুক্তভোগী ছাত্রীর মা-বাবাকে ম্যানেজ করে হয়তো প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন ওই শিক্ষক। এক্ষেত্রে হয়তো ছাত্রীর অভিভাবকের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের ঘটনা ঘটতে পারে বলে জানালেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ রেজাউল করিম কাজল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরই মধ্যে অভিযুক্ত শিক্ষক হোছাইন নিজেকে বাঁচাতে বিভিন্নভাবে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। এমনকি কলেজের অধ্যক্ষ, তদন্ত কমিটির সদস্যদের কাছে এসে চেষ্টা-তদবিরের পরেও নিজেকে নিরাপদ মনে না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ভুক্তভোগী ছাত্রীর মা-বাবাকে ধরে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে একটি আপসনামা সম্পাদন করেছেন। অঙ্গীকারনামা ও আপসনামার কপি এ প্রতিবেদক সংগ্রহ করেছেন।
গত ৭ মার্চ সম্পাদিত অঙ্গীকারনামায় হোছাইন নিজের অপরাধ স্বীকার করেন এবং ভবিষ্যতে কোনো ছাত্রী বা অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে কোনো প্রকার অনৈতিক আচরণ করবেন না বলে অঙ্গীকার করেন। এ অঙ্গীকারনামায় উপরিভাগে অভিযুক্ত শিক্ষক মোহাম্মদ হোছাইন এবং সাক্ষীর এক নম্বর ক্রমিকে ওই ছাত্রীর বাবা সই করেন। এছাড়াও প্রকাশ সিকদার ও শুভ মিত্র নামে দুই ব্যক্তি সাক্ষী হিসেবে এখানে সই করেন।
অন্যদিকে একই তারিখ দেখিয়ে ৩০০ টাকার ননজুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে সম্পাদন করা তিন পৃষ্ঠার আপসনামার উপরিভাগে প্রথম পক্ষে সই করেন অভিযুক্ত শিক্ষক মোহাম্মদ হোছাইন ও দ্বিতীয় পক্ষে ওই ছাত্রী ও তার বাবা।
এ আপসনামায় লেখা হয়েছে, অভিযুক্ত শিক্ষক মোহাম্মদ হোছাইন এবং ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী পূর্ব পরিচিত। ৭ মার্চ ওই ছাত্রী কক্সবাজার সৈকতের কবিতা চত্বরে বেড়াতে যান। সেখানে একটি অনুষ্ঠান উপলক্ষে উপস্থিত ছিলেন মোহাম্মদ হোছাইন। এ সময় ছাত্রী-শিক্ষক দেখা হলে তাদের কথাবার্তা বলার এক পর্যায়ে স্থানীয় ‘কতিপয় বখাটে’ ছেলে হোছাইনের সঙ্গে অশোভন আচরণ করে। বিষয়টি নিয়ে ভুল বুঝাবুঝি হলে সমঝোতা বৈঠক করে তা আপস করা হয়। এখানে সাক্ষী হিসাবে ছাত্রীর মা ছাড়াও শওকত আলম ও শুভ মিত্র নামে দুইজন সই করেন। শুভ মিত্র অঙ্গীকারনামারও তিন নম্বর সাক্ষী।
আপসনামার ভাষ্য মতে, ছাত্রী-শিক্ষক কথা বলার সময় শিক্ষকের (হোছাইনের) সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছে স্থানীয় কতিপয় বখাটে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে হোছাইন ‘ছাত্রীর বাবা এবং ছাত্রীর সঙ্গে’ কেন আপসনামা সম্পাদন করলেন। এতে ছাত্রীর মা কেন সেখানে সাক্ষী হলেন।
বিষয়টি আইনগতভাবে কতটুকু সংগতিপূর্ণ জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের আইনজীবী মোহাম্মদ রেজাউল করিম কাজল বলেন, আপসনামাটা অসংগতিপূর্ণ।
আপসনামার লিখিত ভাষ্য অনুযায়ী প্রথম পক্ষ অভিযুক্ত শিক্ষক হোছাইন আর কতিপয় বখাটে (যারা হোছাইনের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছে) দ্বিতীয় পক্ষ হওয়ার কথা। ঘটনা যদি ঘটেই থাকে, তাহলে এ দুই পক্ষের মধ্যে আপসনামা সম্পাদনের কথা। কিন্তু তা না করে হোছাইন ছাত্রী এবং ছাত্রীর বাবার সঙ্গে আপস করলেন, এখানেই বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
হোছাইন নিজেকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে জানিয়ে কাজল বলেন, ‘এ আপসনামা অভিযুক্ত শিক্ষককে নির্দোষ প্রমাণ করে না।’
ঘটনা সত্য না হলে তিনি অঙ্গীকারনামা কেন দিলেন? আর কোনো ঘটনা না ঘটলে ছাত্রীর বাবার সঙ্গে আপস কেন করলেন? এমন প্রশ্ন অ্যাডভোকেট কাজলের।
তিনি বলেন, আমার ধারণা ছাত্রীর বাবা মাকে আর্থিক সুবিধা দিয়ে, ম্যানেজ করে আপসনামাটি করা হয়েছে। এছাড়াও অঙ্গীকারনামা সম্পাদনের সময় হোছাইন ওই ছাত্রীর বাবাকে ২০ হাজার এবং বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে প্রাথমিকভাবে ম্যানেজ করেছিলেন।
এদিকে ঘটনার পর থেকে ওই ছাত্রীর বাবা-মা রহস্যজনক আচরণ করছেন এবং সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলছেন। এসব বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য ওই ছাত্রীর মাকে একাধিকবার ফোন কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। অন্যদিকে বাবা একবার ফোন কল রিসিভ করলেও সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোন কল কেটে দেন।
অভিযুক্ত শিক্ষকের শাস্তি চান শিক্ষক ও সুশীল সমাজ:
অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠজন হিসাবে পরিচিত মোহাম্মদ হোছাইনের বিরুদ্ধে কলেজের শিক্ষকেরা প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও তার শাস্তি চান কলেজের সাধারণ শিক্ষকরা।
তারা বলেন, হোছাইন অতীতেও এ ধরনের অনৈতিক ঘটনা ঘটিয়েছেন। তা গণমাধ্যমে প্রকাশ না হওয়ায় পার পেয়ে গেছেন। তাই এ ধরনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি রোধ করা আর কলেজে ছাত্রীদের জন্য শিক্ষার নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য তার শাস্তি হওয়া উচিত।
ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন হোছাইনের জন্য নতুন কিছু নয়। ইতিপূর্বে ওই শিক্ষক এক সহকর্মীর (ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক) বাসায় ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক কাজ করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েন। পরে মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পান। বলেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজের এক সিনিয়র নারী শিক্ষক।
কলেজের আরেক শিক্ষক জানান, প্রভাষক হোছাইনের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের সঙ্গে অনৈতিক আচরণ ছাড়াও অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠজন হওয়াতে প্রায় সময় সিনিয়র সহকর্মীদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করেন। ইতিপূর্বে কলেজের অধ্যক্ষ মুজিবুল আলমের বিরুদ্ধে ওঠা আর্থিক-অনিয়ম দুর্নীতিতে অধ্যক্ষের প্রধান সহযোগী হিসেবেও উঠে আসে এই হোছাইনের নাম। যে কারণে এ ঘটনায় সুষ্ঠু বিচার নিয়ে সংশয়ে আছেন সাধারণ শিক্ষকরা।
রামু কলেজ পরিচালনা কমিটির সাবেক সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম কবীর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রামুর একমাত্র উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রামু সরকারি কলেজ। এখানে আমার-আপনার সন্তান পড়ালেখা করবে। শিক্ষকের কাছে যদি আমাদের ছেলে-মেয়েরা নিরাপদ না হয়, তাহলে আমরা কীভাবে তাদের কলেজে পাঠাব? আমরা এ শিক্ষকের দ্রুত অপসারণ চাই।
তবে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ঘটনার পর থেকে অভিযুক্ত শিক্ষক মোহাম্মদ হোছাইনের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
এদিকে ‘অঙ্গীকারনামা’ ও ‘আপসনামা'য় হোছাইন নিজেকে রামু সরকারি কলেজের এমপিওভুক্ত প্রভাষক দাবি করলেও এ ঘটনার প্রায় সপ্তাহ পার হলেও তিনি কলেজ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেননি।
অন্যদিকে ভুক্তভোগী ছাত্রী বা তার পরিবারের পক্ষ থেকেও কলেজে কোনো অভিযোগ দেওয়া হয়নি। উল্টো কলেজ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তারা ফোন কল রিসিভ করেননি বলে জানিয়েছেন রামু সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মুজিবুল আলম।
ভুক্তভোগী ছাত্রী ও অভিভাবকের আচরণ রহস্যজনক জানিয়ে অধ্যক্ষ মুজিবুল আলম গণমাধ্যমে বলেন, এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ করছে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও ঐতিহাসিক ৭ মার্চের জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকায় তাকে ‘শোকজ’ করা হয়েছে বলেও জানান অধ্যক্ষ।
তদন্ত কমিটির প্রধান ও কলেজের গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুপ্রতীম বড়ুয়া জানান, এ ঘটনায় যে অঙ্গীকারনামাসহ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ডকুমেন্ট আমরা যাচাই-বাছাই করছি। ভুক্তভোগী ছাত্রী, ছাত্রীর অভিভাবক এবং অঙ্গীকারনামা সম্পাদনকারী আইনজীবী, সাক্ষীসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা বের করার। এছাড়াও আগামী ২১ তারিখ পর্যন্ত সময়সীমা থাকলেও এর আগেই প্রতিবেদন পেশ করা হবে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।
যোগাযোগ করা হলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর রেজাউল করিম গণমাধ্যমে বলেন, শিক্ষকতা পেশায় থেকে ‘নৈতিক স্খলন’ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। মন্ত্রণালয় বলেন, আর অধিদপ্তর বলেন, সবাই কিন্তু এ বিষয়ে কঠোর। তদন্তে ‘নৈতিক স্খলনে’র বিষয়টি প্রমাণিত হলেই ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রথম অঙ্গীকারনামা পরে আপসনামা সম্পাদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ ওই দিন ঐতিহাসিক ৭ মার্চের অনুষ্ঠান ছিল। ওই অনুষ্ঠানে তো ওই শিক্ষকেরও উপস্থিত থাকার কথা। শৃঙ্খলা লঙ্ঘন করে তিনি সেখানে গেলেন কেন।
নয়াশতাব্দী/ডিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ