চুয়াডাঙ্গার চাষিদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তুলা চাষ। এই শস্য চাষ লাভজনক এবং জমির উর্বরা শক্তি বাড়াতে সহায়তা করে। তুলা চাষে চাষিদের আকৃষ্ট করতে সরকারিভাবে প্রণোদনা ও তুলার দামের স্থিতিশিলতার দাবি করেছে চাষিরা।
তুলার চাহিদা দেশের বাজারে ব্যাপক রয়েছে। যদিও দাম ওঠানামার কারণে তুলা চাষে চাষিরা কিছুটা আগ্রহ হারাচ্ছে। আমদানী নির্ভরতা কমাতে দেশে হাইব্রিড জাতের চারা তৈরি, তুলা চাষে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও সাথী ফসলের সঙ্গে তুলা চাষ সম্প্রসারিত করতে কাজ করছে চুয়াডাঙ্গা তুলা উন্নয়ন বোর্ড।
চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক তুলা উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্য মতে, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলার সমন্বয়ে চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে দু’জেলায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে তুলা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। চাষ হয় ৩ হাজার ৫৪০ হেক্টর জমিতে। এতে তুলা উৎপাদন হয় ৮ হাজার ৮৫০ মেট্রিকটন।
২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৪ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে তুলা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। চাষ হয় ৩ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে। এতে তুলা উৎপাদন হয় ৯ হাজার ৯৮০ মেট্রিকটন।
২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৪ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে তুলা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। চাষ হয় ৩ হাজার ৯০৫ হেক্টর জমিতে। এতে তুলা উৎপাদন হয় ১১ হাজার ৯৫০ মেট্রিকটন।
২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ৪ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে তুলা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। চাষ হয় ৪ হাজার ২৬ হেক্টর জমিতে। এতে তুলা উৎপাদন হয় ১২ হাজার ৮০ মেট্রিকটন।
২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে তুলা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। চাষ হয়েছে ৪ হাজার ১৮২ হেক্টর জমিতে। এতে তুলা উৎপাদনের সম্ভবনা রয়েছে ১২ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন।
এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে তুলা চাষ হচ্ছে। বর্তমানে উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড জাতের তুলা চাষ করছেন চাষিরা। তুলা ৬ মাসের ফসল হলেও লাভজনক চাষ। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের উচ্চ ফলনশীল জাতের তুলা বোর্ড-১২, ১৩ ও ১৪ জাত, রূপালী-১, হোয়াইট গোল্ড-১ ও ২, ডিএম-৪ এবং শুভ্র-৩ জাতের তুলা চাষ হচ্ছে। এবার গোল ওয়ার্ম পোকা রোধের জন্য চাষিদের বিটি জাতের তুলা চাষ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। কারণ এ জাতের তুলা গাছ ক্ষতিকারক গোল ওয়ার্ম পোকা প্রতিরোধক। দেশে উৎপাদিত ধবধবে সাদা রঙ ও গুণগত মান ভালো হওয়ায় এ তুলার বেশ চাহিদা রয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক তুলা উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, তুলা চাষের জন্য উপযোগী দো-আঁশ ও পলিযুক্ত মাটি এবং উচুঁ জমি। বৈরি আবহাওয়া ঠেকাতে বীজতলায় বীজ বপণের ১০-১২ দিন পর মূল জমিতে চারা রোপণ করতে চাষিদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। প্রতি মৌসুমে ১৫ থেকে ৩০ জুনের মধ্যে চাষিরা তাদের জমিতে চারা রোপণ করেন। হাইব্রিড জাতের বীজ আগাম বপণ করতে হয়। তুলার জমিতে জৈব সারের ব্যবহার বেশি। শুধু পোকা-মাকড় দমণের জন্য কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়।
তুলা চাষে প্রতি বিঘা জমিতে ১৮ থেকে ২২ হাজার টাকা খরচ হয়। তবে যে চাষি শ্রমিক না নিয়ে নিজেই জমিতে কাজ করেন, তার খরচ তুলনামূলক কম হয়। বিঘায় ১২ থেকে ১৫ মণ তুলা পাওয়া গেলে খরচ বাদে বিঘায় লাভের সম্ভাবনা ৪৫ থেকে ৫২ হাজার টাকা। প্রতি মণ তুলার বর্তমান বাজার দর ৩ হাজার ৯শ টাকা।
চুয়াডাঙ্গা শহরতলী দৌলাতদিয়াড় গ্রামের তুলা চাষি সাইফুল ইসলাম বলেন, ৫ বিঘা জমিতে তুলা চাষ করেছি। এতে ৬০ থেকে ৭০ মণ তুলা উৎপাদন হবে। খরচ বাদে আড়াই লাখ টাকা লাভ হবে বলে আশা করছি।
একই গ্রামের আরেক তুলা চাষি জসিম উদ্দিন জানান, এক বিঘা জমিতে তুলার সাথে সাথী ফসল হিসেবে লালশাক আবাদ করেছি। ৮ হাজার টাকার লালশাক বিক্রি করেছি এবং নিজেও খেয়েছি। দুর্যোগের কারণে তুলার গুটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এবার ফলন ভালো হয়নি। সে কারণে বিঘায় ১০ থেকে ১২ মণ তুলা উৎপাদন হবে। এক বিঘা জমিতে তুলা চাষে খরচ হয় ১৫ হাজার টাকা। খরচ বাদে প্রায় ৬০ হাজার টাকা লাভ হবে।
চুয়াডাঙ্গা বেলগাছী এলাকার তুলা চাষি সারজেত আলী বলেন, এবার ১৫ কাঠা জমিতে তুলার সাথে মাসকলাই আবাদ করেছি। বৃষ্টির কারণে অনেক মাসকলাই নষ্ট হয়ে গেছে। তবুও খরচ বাদে তুলা ও মাসকলাই বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকা লাভ হবে।
চুয়াডাঙ্গার প্রধান তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা সেন দেবাশীষ জানান, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে তুলা গাছ ভালো হওয়ার পরও কিছু ফুল ও কুঁড়ি ঝরে যায়, ফলে তুলার ফলন কিছুটা কম হবে। তারপরও কৃষকদের সময় মতো পরামর্শ দেয়ায়, তারা ভালো ফলন পাবে বলে আশা করা যায়। গত বছর বিটি জাতের তুলা বীজ প্রদর্শনী আকারে কৃষকদের দেয়া হয়েছে। এ জাতের তুলা বীজ দিতে পারলে তাদের জমিতে তুলার ক্ষতিকারক গোল ওয়ার্ম পোকা ক্ষতি করতে পারবেনা। কীটনাশক খরচ কম হবে, পরিবেশ দূষণ কমে যাবে। কৃষকরা এ জাতের তুলা চাষ করলে তুলার উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
তিনি আরও বলেন, দেশে ৮৪ শতাংশ রপ্তানি আয় হয় বস্ত্র খাত থেকে। এটার কাঁচামাল হচ্ছে তুলা। প্রতি বছর বস্ত্র উৎপাদনে ৮০ থেকে ৮২ লাখ বেল তুলা প্রয়োজন হয়। এ চাহিদার মাত্র ২ শতাংশ জোগান দিতে পারে দেশে উৎপাদিত তুলা। যা অত্যন্ত নগণ্য। সে কারণে সরকার তুলা খাত আরো সম্প্রসারিত করে এ চাষ সমৃদ্ধশালী করার আহ্বান জানিয়েছেন।
নয়াশতাব্দী/এনএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ