ঢাকা, শনিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ১ রবিউস সানি ১৪৪৬

পঞ্চপাণ্ডবের বখরা দিয়েই চলছে নিষিদ্ধ পলিথিন    

প্রকাশনার সময়: ১৩ মার্চ ২০২৪, ১৮:০৩

নোয়াখালী জেলায় নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহারে পঞ্চপাণ্ডবের বখরা দিয়েই কারখানাগুলোতে পলিথিন উৎপাদন করছে অভিযোগ উঠেছে। সবচেয়ে বেশী কারখানা রয়েছে চৌমুহনীতে। আবার এসব পলিথিন চৌমুহনী বাণিজ্য বিতান মার্কেটের নিচতলায় সাঁটিহাটা যোগীতে শতাধিক গুদাম রয়েছে। এসব গুদাম থেকে পলিথিন বিভিন্ন উপজেলা ও জেলাতে ছড়িয়ে পড়ছে। তবে এসব কারখানায় নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো ছাড়পত্র ও অনুমোদন।

জানা যায়, মাসিক অর্থ নেওয়া এসব পঞ্চপাণ্ডবদের বখরার বিভিন্ন অংশ যাচ্ছে প্রশাসনের অসাধু কিছু কর্মকর্তার হাতে, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে, কথিত সাংবাদিক পরিচয়কারীদের মাসিক খামে, নিষিদ্ধ পলিথিন সমিতি কাছে এবং পলিথিন নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেট চক্রের কাছে।

এদিকে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং পরিবেশ অধিদপ্তর কর্মকর্তারা নিষিদ্ধ পলিথিন কারখানা বন্ধ করতে কি ভূমিকা রাখছে, তা নিয়ে জনমনে নানা সংশয় ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পঞ্চপাণ্ডবের কাছে কি তাহলে প্রশাসন অসহায়! নাকি টাকার কাছে অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। প্রশাসনের নাকের ডগায় কিভাবে চলছে নিষিদ্ধ পলিথিন কারখানা? সাধারণ মানুষ বিষয়টি নেতিবাচক হিসেবেই দেখছে।

এসব কারখানা থেকে বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে দৈনিক লক্ষ লক্ষ টাকার নিষিদ্ধ পলিথিন। যাচ্ছে চৌমুহনী থেকে বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও কাঁচাবাজারে। এমন এলাকা পাওয়া দুষ্কর যেখানে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নেই। শহর কিংবা গ্রামের মধ্যে কোনো তফাত নেই। সব জায়গায় ক্রেতারা বাজার করতে যায় খালি হাতে। আর ফিরে আসে পলিথিনের ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী গোপনে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাত করছেন। তবে নিয়মিত অভিযান না থাকায় পলিথিনের বিক্রি ও ব্যবহার আগের তুলনায় অনেকাংশে বেড়ে গেছে। ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা বাড়ছে।

চৌমুহনীতে বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়- অভিজাত রেস্টুরেন্ট, মুদি দোকান, কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে ফুটপাতের প্রায় সব দোকানের পণ্য বহনে ব্যবহৃত হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ। সহজলভ্য ও ব্যবহারে সুবিধা থাকায় ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই ক্ষতির দিক বিবেচনা না করে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করছেন। পরিবেশবিদরা বলছেন, নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহারে শাস্তির বিধান রেখে আইন করা হলেও কমেনি পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার। পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহারে পরিবেশের ক্ষতির কথা চিন্তা করে ২০০২ সালে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়। তখন বিকল্প হিসেবে কাগজ ও পাটের ব্যাগের প্রচলন শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে আইনের প্রয়োগ না থাকায় পলিথিন বিক্রি ও ব্যবহার বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। পলিথিন ব্যাগ বন্ধের আইন ও বিধিমালা রয়েছে। যারা এটা কার্যকর করবে, তারা এটা করছে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়মিত মনিটরিং ও অভিযান না চলার কারণে প্রকাশ্যে ব্যবহার হচ্ছে পলিথিন।

অভিযান বিষয়ে জানা যায়, গত বছর ২০২২ সালের ১৬ মার্চ চৌমুহনী দক্ষিণ বাজারের একটি কারখানায় অভিযান চালিয়ে একটি অবৈধ পলিথিন কারখানাকে ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছিলেন বেগমগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ কামরুল হাসান চৌধুরী। পরে ২৫ এপ্রিল বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শামসুন্নাহার চৌমুহনী বিসিকে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরির করার অভিযোগে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে এসপি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং কারখানাকে ১ লাখ টাকা, ভাই ভাই প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংকে ১ লাখ ও আল মদিনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং কারখানাকে ৫০ হাজার টাকাসহ মোট ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করেন। কিন্তু অভিযান পরবর্তী কারখানাগুলো ফের নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরি করছে প্রশাসনের নাগের ডগায়।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, চৌমুহনী শ্রী শ্রী রামঠাকুর মন্দির গেটের পূর্ব গলিতে একটি পলিথিন কারখানা রয়েছে। চলে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরি। নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো ছাড়পত্র ও অনুমতি। কারখানার মালিক জানান, প্রশাসন অভিযান চালিয়ে জরিমানা করে টাকা নিয়ে যায়। গোপনে আবার পলিথিন তৈরি করে তারা। সব জায়গায় তৈরি হলে এখানে উৎপাদন হতে সমস্যা নেই। এসব নিউজ করে কোনো লাভ নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এক পর্যায়ে সবার সাথে যোগাযোগ আছে বলেও জানান।

অপরদিকে চৌরাস্তা বিসিক নগরীর ভেতরে কয়েকটি নিষিদ্ধ পলিথিন কারখানা রয়েছে। পাশাপাশি দক্ষিণ গোলাবাড়িয়ায়ও কয়েকটি নিষিদ্ধ পলিথিন কারখানা রয়েছে। সিলগালা না করায় অভিযানের পর ফের চালু করে পলিথিন তৈরি করে এসব কারখানা। অনেকের মতে, প্রভাবশালী ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই নাকি চলে এসব কারখানা।

নিষিদ্ধ পলিথিন নিয়ে আইন কি বলে:

প্রায় ২২ বছর আগে করা পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে ২০০২ সালে সংশোধনী এনে পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাত নিষিদ্ধ করা হয়। পলিথিন নিয়ে আইন যা বলে, ‘সরকার নির্ধারিত পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণে প্রথম অপরাধের দায়ে অনধিক ২ (দুই) বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ (দুই) লাখ টাকা অর্থদণ্ড (জরিমানা) বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ২ (দুই) বছর, অনধিক ১০ (দশ) বছরের কারাদণ্ড বা ২ (দুই) লাখ টাকা, অনধিক ১০ (দশ) লাখ টাকা অর্থদণ্ড (জরিমানা) বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন অপরাধীরা।

বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের দায়ে অনধিক ১ (এক) বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড (জরিমানা) বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের দায়ে ২ (দুই) বছর, অনধিক ১০ (দশ) বছরের কারাদণ্ড বা ২ (দুই) লাখ টাকা, অনধিক ১০ (দশ) লাখ টাকা অর্থদণ্ড (জরিমানা) বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন অপরাধীরা।

‘পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সামগ্রী উৎপাদন, বিক্রয় ইত্যাদির ওপর বাধা-নিষেধ’ শীর্ষক আইনের ৬(ক) ধারায় বলা হয়, সরকার মহাপরিচালকের পরামর্শ বা অন্য কোনোভাবে যদি সন্তুষ্ট হয় যে সকল বা যেকোনো ধরনের পলিথিন শপিং ব্যাগ বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরি অন্য কোনো সামগ্রী বা অন্য যেকোনো সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তাহলে সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে সারা দেশে বা কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় এ ধরনের সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার বা প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত শর্তাধীনে ওই সকল কার্যক্রম পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নির্দেশ জারি করতে পারবে। নির্দেশ পালনে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি বাধ্য থাকবেন।

নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার নিয়ে স্বাস্থ্যবিদরা কি বলছেন:

পলিথিন বর্তমান সময়ে অপরিহার্য উপাদান। প্রায় সব জায়গাতে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। পলিথিনে খাবার সংগ্রহ করে তা গ্রহণের ফলে মানব শরীরে বাসা বাঁধছে ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগ। বর্তমানে ছোট-বড় সব ধরনের হোটেল বা রেস্তোরাঁতে দেখা যায় পলিথিনের ব্যবহার। বিশেষজ্ঞদের মতে, পলিথিনে গরম খাবার ঢালার সঙ্গে সঙ্গে বিসফেলন-এ তৈরি হয়।

বিসফেলন-এ থাইরয়েড হরমোনকে বাধা দেয়, বিকল হতে পারে লিভার ও কিডনি। বিসলেন-এ গর্ভবতী নারীর রক্তের মাধ্যমে ভ্রূণে চলে যাওয়ার কারণে ভ্রূণ নষ্ট হতে পারে এবং দেখা দিতে পারে বন্ধ্যাত্ব। সদ্যোজাত শিশুও বিকলাঙ্গ হতে পারে। পলিথিনের ব্যাগে করে ফ্রিজে রেখে দেওয়া খাবার গ্রহণ করলেও সমান ক্ষতি হতে থাকে।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের নোয়াখালী জেলার সহ-পরিচালক তানজিল তারেক বলেন, নিষিদ্ধ পলিথিন কারখানাগুলোতে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মূল ব্যবসায়ীরা কৌশল পাল্টিয়ে ভ্রাম্যমাণভাবে পলিথিন উৎপাদন করছে। আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। নিষিদ্ধ পলিথিন কারখানাগুলোতে মোবাইল কোর্ট করে জরিমানা করা হয়েছে। অনেক কারখানা সিলগালাও করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জেলার জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. কাউসার মিয়া বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা চৌমুহনীসহ বিভিন্ন স্থানে অবৈধ এসব কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছি। ব্যবসায়ীরা কৌশল পাল্টিয়ে গোপনে পলিথিন উৎপাদন করে। তার পরেও আমরা মনিটরিং করছি।

এ বিষয়ে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অনেক কারখানার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চৌমুহনীসহ অন্যান্য জায়গায় নিষিদ্ধ পলিথিন কারখানায় অভিযান করা হয়েছে। অনেক কারখানা বন্ধ করা হয়েছে।

নয়াশতাব্দী/টিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ