ঢাকা, শনিবার, ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১, ১০ রজব ১৪৪৬

রাত হলেই বাড়ে ভয়, সীতাকুণ্ডে বেপরোয়া ডাকাত বাহিনী

প্রকাশনার সময়: ১১ মার্চ ২০২৪, ১৬:৫২
ছবি: গরু হারিয়ে দিশেহারা এক কৃষক।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় উদ্বেগজনক হারে চুরি-ডাকাতি বেড়েছে। অধিকাংশ চোরই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কোনভাবেই ডাকাতের দৌরাত্ম্য থামানো যাচ্ছে না। আস্থার অভাবে অনেকেই থানায় অভিযোগ জানাতেও যান না। ফলে চুরি ঠেকাতে উপজেলার বারৈয়াঢালা ইউনিয়নের পূর্ব লালানগর গ্রামে যুবক-বৃদ্ধরাসহ কয়েকটি বিভিন্ন গ্রামে স্থানীয় লোকজন রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন।

তবুও কি থেমেছে চুরি-ডাকাতি? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সীতাকুণ্ড উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। স্বর্বস্ব হারিয়ে অসহায় অনেক পরিবার। এরইমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতির পর এবার বেড়েছে গরু চুরি। প্রতিরাতেই কোনো কোনো গ্রামে গরু চুরি হচ্ছে। শুক্রবার (৮ মার্চ) দিবাগত রাতে পৌরসদর শেখপাড়া এয়াকুব নগর এলাকায় এক কৃষকের গোয়ালঘরের দরজা কেটে চারটি গরু নিয়ে যায় চোর চক্র। এত রাতে মহাসড়কে গরু বোঝাই করতে দেখে সন্দেহ হয় নুর মোস্তফা নামের এক সিএনজিচালকের। একই সময়ে টহলরত একটি পুলিশ ভ্যান দেখতে পেয়ে ওই সিএনজিচালক গরুভর্তি গাড়িটি দেখিয়ে দেন পুলিশের টিমকে। পরে পুলিশ সিএনজিচালককে সঙ্গে নিয়ে চোরদের ধাওয়া করে। কিছুদূর পর সিএনজ চালক চলে আসলেও পুলিশ চোরদের পিছু নিয়েও ধরতে সমর্থ হননি। সিএনজি চালকের বর্ণনামতে এমনটি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী কৃষক বদিউল আলম। বিষয়টির সত্যতা জানতে ওই সিএনজি চালকের সাথে কথা হয়।

এদিকে গত এক মাসে উপজেলায় সঙ্ঘবদ্ধ ডাকাতির ঘটনায় ঘরের মালামাল, নগদ টাকা, মোবাইল ও স্বর্ণালঙ্কারসহ বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে। এতে আতঙ্কিত এলাকাবাসী। চোরের দৌরাত্ম্য থেকে রেহাই পাননি জনপ্রতিনিধি, প্রবাসী, ব্যবসায়ী, এমনকি দুই সাংবাদিকের পরিবারও। একমাসের ব্যবধানে ছয়টি দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। প্রতিকার না পেয়ে অনেকে থানায় অভিযোগ করেননি। ধারাবাহিকভাবে একের পর এক ডাকাতির ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন ওঠে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও।

সর্বশেষ সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) উপজেলার পৌরসভা এলাকায় দৈনিক আজাদী অনলাইন ও যায়যায়দিন পত্রিকার সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি শেখ সালাউদ্দিনের বাড়িতে গভীর রাতে হানা দিয়েছে ডাকাত দল। এসময় ডাকাতের হামলায় আহত হন সালাউদ্দিনের ভাই শেখ রাসেল ও মেয়ের জামাই জাহাঙ্গীর। ডাকাত দল লুট করে নিয়ে যায় সাংবাদিক পরিবারের নগদ ১ লাখ চল্লিশ হাজার টাকা, সাড়ে ৭ ভরি সোনা ও পাঁচটি মোবাইল।

শেখ সালাউদ্দিন বলেন, শেখপাড়া এলাকায় আমার বাড়িতে রাত ৩টার দিকে ডাকাত দল হানা দেয়। এসময় পরিবারের সদস্যদের জিম্মি করে আলমিরা ভেঙে নগদ টাকাসহ-স্বর্ণালঙ্কার লুট করে নিয়ে গেছে তারা। ডাকাতদের বাধা দিতে গিয়ে আমার ভাই প্রবাসী রাসেল এবং মেয়ের জামাই জাহাঙ্গীরকে ছুরিকাঘাত করেছে ডাকাত দল। পরে তারা স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। ডাকাতির ঘটনায় ভুক্তভোগী সাংবাদিকের পরিবার মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিলেও মামলা নেয়নি পুলিশ।

এর আগে, গত (৬ ফেব্রুয়ারি) রাতে উপজেলার বারৈয়াঢালা ইউনিয়নের ফেদাইনগর এলাকায় একুশে টিভির বিশেষ প্রতিনিধি হাসান ফেরদৌসের বাড়িতে ডাকাতদল হানা দিয়েছিল। একই রাতে ডাকাতরা ওই এলাকার সাবেক মেম্বার আমানউল্লাহ ও তার পাশের বাড়িতে হামলা করে।

ডাকাতির শিকার হয় সৈয়দপুর ইউনিয়নের আশু টেন্ডলের বাড়ির বাসিন্দা প্রবাসী আব্দুল মন্নান। এসময় ডাকাতদল তিন ভরি সোনা, নগদ ২০ হাজার টাকা ও দুটি মোবাইল নিয়ে যায়। ওই রাতে ডাকাত দল হামলা করে উত্তর কেদারখীল গ্রামের বোরহান উদ্দিনের বাড়িতে। তবে সেখানে মালামাল লুট করতে না পেরে বোরহান উদ্দিন ও তার শ্বশুর নুরুল আবছারকে কুপিয়ে জখম করে ডাকাতরা। এছাড়াও ১৯ জানুয়ারি রাতে মুরাদপুর ইউনিয়নের হাসনাবাদ এলাকার রেহান উদ্দীনের বাড়িতে একই রাতে দুদফা চুরি চেষ্টা করে ডাকাত দল। সুবিধা করতে না পেরে পালিয়ে যায়।

এদিকে, ডাকাতির শিকার ভুক্তভোগী পরিবার বলছেন, ডাকাতদের কথাবার্তা উত্তরবঙ্গের টান ছিল। বেছে বেছে ডাকাতি হচ্ছে সাংবাদিকদের বাড়ি টার্গেট করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন এদের নেতৃত্বে কারা?

সাংবাদিক শেখ সালাউদ্দীনের বাড়িতে পরিদর্শনে করে সীতাকুণ্ড পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম বলেন, পৌরসভায় ইতোপূর্বে কখনও ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি। আজকের এ ঘটনায় আমি উদ্বিগ্ন। এক্ষেত্রে পৌরবাসীর জানমালের নিরাপত্তায় পুলিশের কার্যকরী ভূমিকা আশা করছি। ডাকাতদের প্রতিরোধ করতে সোচ্চার হতে বলেন তিনি।

এদিকে আগামী কোরবানির ঈদে বিক্রির আশায় পালন করা চারটি গরু হারিয়ে কৃষক বদিউল আলমের কান্না থামছে না। নিজের সন্তানের মতো যত্ন করে পালিত গরু হারিয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছে কৃষক। ঋণ নিয়ে নেওয়া গরু ছুরি হওয়ায় চিন্তায় পড়েছেন কুষক বদিউল আলম। এখন কিভাবে এই কর্জ শোধ করবেন সেটি বলে আর্তনাদ করছেন অসহায় এই কৃষক।

কাঁদতে কাঁদতে বদিউল আলম বলেন, ওরা গরু ছিল না, আমার বাচ্চা ছিল, নিজের সন্তানদের কম খাইয়ে গরুকে খাইয়েছিলাম। আমি কখনই গরুর পেট খালি হতে দেইনি। আমি বাচ্চাদের শখ পূরণ করিনি, শুধু গরুর খাবার ও পরিচর্যার যেন কোনো অভাব না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য। আগামী কোরবানির ঈদে গরু বিক্রি করে ছেলে-মেয়েদের চাহিদা পূরণ করতে চেয়েছিলাম। এছাড়া দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে একটি গরু কিনেছি। এখন কিভাবে ঋণ পরিশোধ করব? মরে যাওয়া ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। এভাবেই আর্তনাদ করতে থাকেন তিনি।

বদিউল আলমের ছেলে রিয়াজ বলেন, এক সিএনজি অটোরিকশাচালক গরু চুরির ঘটনা দেখে পুলিশে খবর দেন। পুলিশের একটি গাড়ি চোরদের ধাওয়া করে। কিন্তু পরে কী হলো তা আমাদের কিছু জানায়নি। আমরা থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছি।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সিএনজি অটোরিকশাচালক নুর মোস্তফা বলেন, ‘রাতে চোরদের দেখেই টহলরত পুলিশকে ঘটনাটি জানিয়েছি। পুলিশও গাড়িটিকে ধাওয়া করে। আমিও তাদের পিছু নিলাম। কিন্তু গাড়ি দুটির গতি বেশি হওয়ায় শুকলালহাট বাজার থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে এসেছি। কিন্তু আমি জানি না কেন সেই গাড়িটি ধরতে পারেননি বা কী হয়েছে আর জানতে পারিনি।

প্রত্যক্ষদর্শী অটোরিকশাচালকের কথার সঙ্গে সীতাকুণ্ড মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল উদ্দিনের কথারও মিল আছে। ধারাবাহিক চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও মালামাল উদ্ধার করতে পারেনি থানা পুলিশ। একের পর এক ডাকাতি চরম উদ্বেগ দেখা দিয়েছে এই উপজেলায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে, গরু চুরি ঘটনা সত্যতা স্বীকার করে সীতাকুণ্ড মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল উদ্দিন বলেন, পুলিশ চোরের গাড়ি ধরতে ধাওয়া করলেও ধরতে পারেনি। এসময় গরু চুরির বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে বিরক্তি প্রকাশ করেন তিনি বলেন, পুলিশ গরু চুরি নিয়ে বসে নেই। আপনাদের যা ইচ্ছা লিখে দেন। ভুক্তভোগী মামলা করলে ব্যবস্থা নেব।

নয়া শতাব্দী/এসএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ