সফলতা একদিনে আসে না। জীবনে সফলতার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। পরিশ্রম ও সময় দিলে অসম্ভব কে সম্ভব করে তোলা যায়। সফলতা আসলে কারো কাছে চেয়ে খেতে হবে না।
‘স্বামী হারা ৫৫ বছর বয়সী মাজেদা বেগম এভাবেই নিজের অভিমত ব্যক্ত করেন। রাজশাহী নগরীর বুধপাড়া এলাকায় রেললাইনের ধারে কলাইয়ের রুটির অস্থায়ী দোকান রয়েছে তার। বাবা হারা এক নাতিকে নিয়ে কষ্টে থাকলেও কারো কাছে চেয়ে খেতে হয় না। মানুষের কাছে হাত পাতা অন্তত আমার দ্বারা হবে না। না খেয়ে পড়ে থাকলেও কারো কাছে হাত পাততে নারাজ আমি। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কলাইয়ের রুটি বিক্রি করি। এই দিয়ে চলে সংসার।’ দোকাটির ওপরে ও চারপাশে পলিথিন দিয়ে ঘেরা। প্রতিদিন রাতে বিক্রি শেষে সব বাড়িতে নিয়ে চলে যেতে হয় তাকে। এখানে শুধু কলাইয়ের রুটি নয়, বিক্রি করেন বারভাজা, চটপটি ও ফুসকাও।
মাজেদা বেগম বলেন, আমার কষ্টের জীবন। কষ্ট করতে করতে গেল। বাবা আমির শেখ ও মা মালেকা ভানুর সংসারে থাকাকালীন এই রুটি বিক্রি করেছি। আমার বাবার অনেক বড় সংসার ছিল। আমরা ১৩ ভাই-বোন ছিলাম। এর মধ্যে সাত ভাই, ছয় বোন। বড় সংসার নিয়ে কষ্ট হতো। তখন আমার বয়স ১০ বছর। পবা উপজেলার রামচন্দ্রপুর থেকে শিরোইলের রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে রুটি বিক্রি করেছি। সেই সময় রুটি কেজি হিসেবে বিক্রি হতো। তখন রুটি ৪০ থেকে ৫০ পয়সা পোয়া ছিল। দাড়ি-পাল্লায় মেপে বিক্রি করতাম।
তিনি বলেন, জীবন সংগ্রামের ৫৫ বছর বয়সে অনেক কিছু করতে হয়েছে জীবিকার তাগিদে। নিজেদের সংসারে অভাবের কারণে শীতের সময়ে ভাপা পিঠা বিক্রি করেছি। ২৪ থেকে ২৫ বছর আগে ভাপা পিঠা দুটি বিক্রি করেছি ৫০ পয়সা করে। পরের দিকে কোনো কোনো সময়ে ৫০ পয়সা পিসও বিক্রি করেছি। এখন তো মানুষ বিক্রি করে ৫ থেকে ১০ টাকা পিস। সেই সময় জিনিসপত্রের দাম কম ছিল। পিঠায় আখ বা খেজুরের গুড়, নারকেল দিতাম। তবে বেশির ভাগ খেজুরের গুড় আর নারকেল দিয়ে ভাপা পিঠা বানিয়ে বিক্রি করতাম। মানুষ লাইন ধরে কিনে খেত। এখনো নতুন দোকান হলেও কলাইয়ের রুটি অনেক মানুষ খায়। দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ আসে রুটি খেতে।
মাজেদা বেগম বলেন, আমাদের জন্মস্থান ছিল ভারতের বাবলাবোনায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে বাবা আমির শেখ বিনিময় করে বাংলাদেশে চলে আসেন। তারপর আমার বাবা পবা উপজেলার রামচন্দ্রপুরে বাড়ি করেন। বাবা নিজের ও বর্গা নিয়ে জমিতে কৃষি কাজ করতেন। এছাড়া অন্য সময়ে তিনি ঘরামির কাজ করতেন। সেই সময় তো শ্রমিকের মজুরি কম ছিল। তাই আমাদের বিভিন্ন কাজ করতে হতো। সংসার জীবনের বিষয়ে তিনি জানান, রেলওয়ে স্টেশনে রুটি বিক্রির সময় ১৬ বছর বয়সে বাবা-মা বিয়ে দেন। বিয়ে হয় পশ্চিম পাকিস্তানের বাসিন্দা লাল মোহাম্মদের সঙ্গে। তবে লাল মোহাম্মদ এলাকায় বিহারি নামে পরিচিত। লাল মোহাম্মদ পেশায় রিকশাচালক ছিলেন।
পরবর্তীতে তিনি নাইটগার্ডের চাকরি করেছেন নগরীর চৌদ্দপাই এলাকায়। লাল মোহাম্মদের গত হওয়া দেড় বছর চলছে। এছাড়া মাজেদার এক ছেলে কামরুল ইসলাম ও দুই মেয়ে রয়েছে। এদের মধ্যে একজন লালবানু ও অপরজন গোলবানু। মাজেদার ছেলে কামরুল ইসলাম রড মিস্ত্রির কাজ করেন। আর দুই মেয়ের মধ্যে গোল বানুর বিয়ে হয়েছে ঢাকায়। বিয়ের আট বছরের মাথায় গোল বানুর স্বামী স্ট্রোক করে মারা যান।
সেই সময়ে তাদের সাত বছরের রনি স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়তো। রনির বাবা মারা যাওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। এরপরে রনি চলে আসে রাজশাহীতে। তার মা গোল বানু থেকে যায় ঢাকায়। বর্তমানে গোলবানু ঢাকা গার্মেন্টসে চাকরি করেন। রনিকে তার নানি স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিয়েছেন। বর্তমানে রনি সেখানেই লেখাপড়া করছে। আর গোল বানুর বিয়ে হয় রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানীতে। তার স্বামী পেশায় রিকশাচালক।
সংসার চলানোর বিষয়ে মাজেদা বলেন, এই দোকান ছাড়াও বাড়িতে হাঁস-মুরগি লালন-পালন করে থাকি। হাঁস, মুরগি বিক্রি ছাড়াও এগুলোর ডিম বিক্রি করি। মানুষের কিনে দেওয়া একটা গরু রয়েছে। সেটি লালন-পালন করি। ছেলেও টাকা দেয়। সব মিলিয়ে তাতেই সংসার চলে। রনিকে হোটেলে কাজে দিয়েছিলাম। সেখানে সে প্রতিদিন ৩০ টাকা করে পেত। সমস্যার কারণে কাজ বাদ দিয়েছে। এখন আমার দোকানেই কাজ করছে।
তিনি জানান, প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ কেজি কালাইয়ের আটার রুটি তৈরি করে বিক্রি করেন। এতে যে টাকা উপার্জন হয়, তা দিয়ে তার সংসার চলে। বিকেলের দিকে বারভাজা, চটপটি আর ফুসকা বেশি বিক্রি হয়। সন্ধ্যার পর থেকে বিক্রি শুরু হয় কলাইয়ের রুটির। সাধারণত রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে তার। তবে কোনো কোনো দিন রাত ১২টাও বাজে দোকান বন্ধ করতে। তার দোকানে আশপাশের এলাকার মানুষ ছাড়াও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা রুটি খেতে আসেন। তারা মূলত বুধপাড়া ফ্লাইওভারে ঘুরতে এসে তার দোকানে রুটি খেয়ে যান।
মাজেদার দোকানে রুটি খেতে আসা রাবি শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন, মাজেদা খালার হাতের রুটি ভালো লাগে। তার রুটির স্বাদ ভালো। এই দিকে বেড়াতে আসলে আমরা মাজেদা খালার হাতের রুটি খেয়ে ক্যাস্পাসে ফিরি। রুটি খাওয়ার জন্য মারিচ দিয়ে যে ঝাল তৈরি করেন সেটির অনেক স্বাদ।
বুধপাড়া সুইপার কলোনির বাসিন্দা অষ্টম বলেন, রুটির সাথে আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা পাওয়া যায়। এছাড়া কাঁচা মরিচের সাথে শশা, টমেটো, বিট লবণ দিয়ে অন্যরকম স্বাদের একটা ঝাল পাওয়া যায় রুটির সাথে। সেই ঝাল দিয়ে রুটি খেতে অনেক ভালো লাগে তার।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আলাউদ্দিন বলেন, তারা নিরীহ মানুষ। মাজেদার স্বামী দেড় বছর আগে মারা গেছেন। তারা বুধপাড়ার রেললাইন বস্তিতে থাকেন। দীর্ঘদিন ধরে মাজেদা কলাইয়ের রুটি বারভাজা, চটপটি আর ফুসকা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
নয়া শতাব্দী/এসএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ