ফরিদপুরের সালথা উপজেলা নির্বাচন অফিসার মো. আব্দুর রশিদ। সব সময় মাথায় টুপি ও গায়ে পাঞ্জাবি পরে সুন্নতি লেবাসে থাকেন। নামাজও আদায় করেন নিয়মিত। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই করেন না তিনি!
ভোটার হওয়ার জন্য তার কাছে গেলে, প্রত্যেক নতুন ভোটারকে গুণতে হবে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। যারা টাকা দিতে পারেন না, মাসের পর মাস ঘুরেও ভোটার তালিকায় তাদের নাম ওঠে না। ফলে ভোটার হওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।
জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল সংশোধন ও ভোটার আইডি হস্তান্তরসহ সব কাজই তিনি টাকার বিনিময়ে করেন। সম্প্রতি একটি ভিডিওতে নির্বাচন অফিসে প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেনের চিত্র দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, নারী সেবাপ্রত্যাশীদের পেলে অসদাচরণ ও হেনস্থা করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এর আগে নির্বাচন অফিসারের এসব ঘুষ-বাণিজ্য নিয়ে মিডিয়ায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও তার বিরুদ্ধে কোনোধরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যে কারণে বর্তমানে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেছেন তিনি।
অন্যদিকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ৫ রোহিঙ্গাকে ভোটার বানানোর অপচেষ্টাও চালান তিনি। পরে ইউএনওর হস্তক্ষেপে ওই পাঁচ রোহিঙ্গার ভোটার আবেদন বাতিল করা হয়।
সম্প্রতি নির্বাচন অফিসে ভোটার হতে এসে হেনস্তার শিকার হন উপজেলার গট্টি ইউনিয়নের সিংহপ্রতাপ গ্রামের আজিজ ব্যাপারীর মেয়ে আমেনা আক্তার। গত ৩ মার্চ সকালে তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমি দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলাম। যে কারণে ভোটার হতে পারিনি। দেশে এসে পাঁচ মাস আগে ভোটার হওয়ার জন্য আমি নির্বাচন অফিসে আবেদন করি। কিন্তু অফিস থেকে বিভিন্ন অজুহাতে আমাকে শুধু ঘোরাতে থাকে।
তিনি অভিযোগ করে আরও বলেন, আমি বিষয়টি নির্বাচন অফিসারকে জানাতে গেলে তিনি প্রথমে আমাকে বলেন, বোরকা খুলে মুখ বের করেন। মুখ খোলার পর তিনি আমার চেহারার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকেন। বলেন, মেয়েরা অনেক চালাক। আপনার কাগজপত্রে ঝামেলা আছে। কালকে আসেন। কালকে গেলে বলে পরদিন আসেন। আর আমি অফিসে গেলেই আজে-বাজে কথা বলতে থাকেন। একপর্যায় আমার কাছে ২০ হাজার টাকা দাবি করেন। ওই টাকা আমি দিতে রাজি না হওয়ায়, আমাকে ভোটার বানাবেন না বলে জানিয়ে দেন নির্বাচন অফিসার। ওনার আচরণে মনে হয়েছে, মেয়েদের পেলেই তিনি এমন আচরণ করেন।
ঝুনাখালি গ্রামের পাঞ্জু শেখ নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, আমার শ্যালক ইকবল মাতুব্বরের এনআইডি কার্ড করতে গেলে নির্বাচন অফিসারের কথা বলে অফিসের কর্মচারী সাইফুল ৫ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে বাধ্য হয়ে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে শ্যালকের এনআইডি কার্ড করেছি।
এদিকে ওই ভিডিওতে দেখা যায়, নির্বাচন অফিসের কর্মচারী সাইফুল এক সেবা প্রত্যাশীর কাছ থেকে প্রকাশ্যে ঘুষ নিচ্ছে।
একাধিক সেবাপ্রত্যাশী জানান, ভোটার হওয়ার জন্য আমরা জনপ্রতি ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়েছি। কিন্তু আমাদের এনআইডি কার্ড এখনো বের হয়নি। কেউ কেউ টাকার বিনিময় জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল সংশোধনের জন্য আবেদন করেছেন।
তারা বলেন, আমাদের কাজ চলমান। তাই নাম প্রকাশ করলে নির্বাচন অফিস থেকে ঝামেলা করতে পারে।
সালথা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ভাওয়াল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ফারুকুজ্জামান ফকির মিয়া বলেন, সালথা নির্বাচন অফিস এখন দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত। আমার ইউনিয়নের কেউ ভোটার হতে গেলে টাকা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে ভোটার হতে পারে না। যে কোনো কাজে গেলেই টাকা ছাড়া করে না। এমন ঘুষখোর নির্বাচন অফিসার জীবনেও দেখিনি। আমি এই নির্বাচন অফিসারের অপসারণ দাবি করছি।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সালথা উপজেলা নির্বাচন অফিসার মো. আব্দুল রশিদ বলেন, ওই নারীর সঙ্গে আমার একদিন দেখা হয়েছে। তার আচরণ মোটেও ভালো না। সে ৪০ বছর বয়সে ভোটার হতে এসেছে। তাই আমি তার মুখ দেখতে চেয়েছি। কারণ এর আগে রোহিঙ্গারা ভোটার হতে এসেছিল। তখন ঝামেলায় পড়েছিলাম। ওই নারীর সঙ্গে কোনো ধরণের আজে-বাজে কথা হয়নি।
সেবাপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার বিষয়টিও অস্বীকার করে তিনি বলেন, কারো কাছ থেকে অফিসের কেউ টাকা নিলে, সেটা আমি জানি না। আমার অফিসে কোনো ধরণের ঘুষ লেনদেন হয় না।
সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আনিছুর রহমান বালী বলেন, প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেনের যে ভিডিও প্রকাশ হয়েছে, সে বিষয়ে তদন্ত করা হবে। তাছাড়া ভোটার হতে এসে ওই নারীসহ যারা হয়রানি শিকার হচ্ছেন, তারা অভিযোগ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নয়াশতাব্দী/এনএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ