‘এখন সবকিছুরই দাম বেশি। আগে সপ্তাহে একদিন বাড়িতে মুরগি কিনি নিয়্যা গেছি। আর দুই-একদিন কম দামি সিলভার, পাঙ্গাশ মাছ কিনি নিয়্যা গেছি। কিন্তু এখন মাসেও আর মুরগি কেনা যায় না। যে বোলডার (ব্রয়লার) আগে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা ছিল, সেই মুরগিও এখন দুইশো টাকার উপরে। চাল, ডাল, তেল, আদা, রসুনের দাম অনেক বেশি। মাংস খেতে গেলে এসব লাগে। গরু-খাসির মাংস কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া আর খাওয়া হয় না বললেই চলে।’
কথাগুলো বলছিলেন গাইবান্ধা সদর উপজেলার খোলাহাটি ইউনিয়নের দশানি গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান বাবু।
গরুর মাংস কিনতে বাজারে এসেছেন এনজিও কর্মী সুইট সরকার। নয়া শতাব্দীকে তিনি বলেন, ‘আগে বাজারে এলে এক মাসে কমপক্ষে ৫ কেজি গরুর মাংস কিনতাম। এখন সব ধরনের মাংসের দাম বেশি। তাই ২ কেজি কিনেছি। অন্য জিনিস কিনতে আরও টাকা লাগবে। আমরা নির্দিষ্ট বেতন পাই। এই স্বল্প বেতনে বাধ্য হয়েই মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি।’
শহরের পুরাতন বাজারে সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় সদর উপজেলার পূর্ব কোমরনই মিয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা এবং শহরের পুরাতন বাজারের গরুর মাংস ব্যবসায়ী সিদ্দিক, মাজেদ, ইকবাল ও নুর আলমের সঙ্গে। নয়া শতাব্দীকে তারা জানান, ‘আগে সারাদিন ১০ থেকে ১১টি গরুর মাংস বিক্রি করতাম। এখন সারাদিন ২ থেকে ৪টি গরু জবাই করে ৮ থেকে ১০ জন কসাই মাংস ভাগ করে নিয়ে বিক্রি করি। মানুষের আয় কমে গেছে। হাতে টাকা নাই। এদিকে গরুর হাটে চড়া দামে গরু কিনতে হয়। ৭শ সাড়ে ৭শ টাকা দিয়ে সবাই মাংস কিনতে পারে না। তাই গরুর মাংস বিক্রি অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। কর্মচারীদের বেতন দিতেই কষ্ট হয়। আগের তুলনায় শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ গরুর মাংস কেনা কমিয়ে দিয়েছে।’
পৌর শহরের ব্রিজরোড কালিবাড়ি পাড়ার খাসির মাংস ব্যবসায়ী সাব্বির মিয়া দীর্ঘ ২০ বছর ধরে পুরাতন বাজারে ব্যবসা করছেন। তার ব্যবসায়ীক জীবনে এত কম খাসির মাংস আগে কখনো বিক্রি করেননি। পুরাতন বাজারে তার মতো আরও দুইজন খাসির মাংস ব্যবসায়ী শহরের কুটিপাড়ার হাসেম মিয়া ও রাজা মিয়া।
মাংস বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা এ প্রতিবেদককে জানান, ‘হাটেই একটা খাসির কিনতে কেজিপ্রতি ৯০০ টাকার ওপরে পড়ে। আমাদের এক হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হয়। একজন সাধারণ মানুষ সারাদিনে আয় করে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। এই টাকায় খাসির মাংস কেনা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আগের তুলনায় খাসির মাংস ক্রেতা একেবারেই কমে গেছে।’
তারা আরও বলেন, ‘আগে সারাদিনে ১০ থেকে ১২টি খাসির মাংস বিক্রি করেছি। বর্তমানে ৪ থেকে ৫টি বিক্রি করতেও অনেক কষ্ট হয়। এসব ক্রেতার অধিকাংশই এখন মুরগি এবং মুরগির চামড়া, গিলা ও কলিজা কেনেন।’
শহরের পুরাতন বাজারের মুরগি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত একমাস থেকে ব্রয়লার মুরগি ১৯০ থেকে ২২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। লেয়ার মুরগি ২৯০ টাকা কেজি এবং কক মুরগি বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ২৬০ টাকা থেকে ২৮০ টাকায়। দেশি মুরগি ৫৫০ টাকা এবং হাঁস বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকা কেজি দরে।
মাছের বাজারের দৃশ্যও অনেকটা একই রকম। কম দামের মধ্যে একমাত্র দেশি মুসা মাছ ২০০ টাকা কেজিতে পাওয়া যাচ্ছে। পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, যা আগে ১৫০ টাকা কেজি ছিল; তা এখন রকমভেদে ২২০ থেকে ২৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। সুস্বাদু রুই, কাতলা, চিংড়ি ও দেশি মাছ ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর আকারভেদে ইলিশ কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১৮০০ টাকায়।
বাজারে মুরগি কিনতে এসেছিলেন শহরের ব্রিজরোডের বাসিন্দা রোজী বেগম। স্বামীর সীমাবদ্ধ আয়ের কথা উল্লেখ করে নয়া শতাব্দীকে তিনি বলেন, ‘আগে ছেলে-মেয়েদের মুরগিই কিনে খাওয়াইতাম। কিন্তু এখন মুরগি কিনতে গেলে ওজন ভেদে ৫০০ টাকার উপরে পড়ে। গরুর মাংস, খাসির মাংসের দাম অনেক বেশি। তাই মুরগির চামড়া, পাখা, গিলা-কলিজা কিনছি। বাচ্চাদের লেখাপড়ার খরচ, দুধ-ডিম সবকিছুতেই বাড়তি খরচ বেড়ে গেছে। এত টাকা দিয়ে মাংস কিনলে অন্য বাজার আর করাই যাবেনা।’
বেসরকারি একটি হাসপাতালের ফার্মেসির বিক্রয় প্রতিনিধি চন্দন কুমার বাজারে খাসির মাংস কিনতে এসেছিলেন। হিসাব না মেলায় মাছ কিনেছেন। আর বাকি টাকায় মুরগির গিলা কলিজা কিনবেন। নিজের অসহায়ত্বের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কি করবো! মায়ের অসুখ। ডাক্তার, ওষুধ এবং হাসপাতালের খরচ মেটাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাকে ভালো-মন্দ খাওয়াতে হয়। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ কমানো সম্ভব নয়। তাই খাওয়া-দাওয়ার খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছি।’
মুরগির গিলা-কলিজার দাম নিয়ে বিক্রেতাদের সঙ্গে অনেকটা হৈ-হুল্লোড় করছেন সদর উপজেলার পুলবন্দি এলাকার বৃদ্ধা সুফিয়া বেওয়া। অনেকটা আক্ষেপের সুরে তিনি নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘কয়েকদিন আগেও এই পুরাতন বাজারে গিলা-কলিজা এক কেজি ১৪০ টাকায় কিনচি। আজকে সেই গিলা-কলিজার দাম চাচ্ছে এক কেজি ১৮০ ট্যাকা। তাও আবার বাছি নিব্যার দিব্যের নয়।’
মুরগি না কিনে কেনো গিলা-কলিজা কিনছেন, জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গৃহবধূ বলেন, ‘এক কেজি মুরগি ২২০ টাকায় কেনার পর মাংস পাওয়া যায় মাত্র ৬শ গ্রাম। এক কেজি গিলা-কলিজা ১৮০ টাকায় কেনা যায়। যার কোনোকিছুই ফেলতে হয় না। সেজন্য গিলা-কলিজা কিনলেই বেশি লাভ।’
গরু এবং খাসির মাংস আমিষের একটি অন্যতম মাধ্যম। সাধারণ মানুষের আয় কমে যাওয়ায় ক্রয় ক্ষমতাও কমেছে এসব গুরুত্বপূর্ণ আমিষ পণ্যের ক্ষেত্রে। বাধ্য হয়েই গরু ও খাসির মাংস কেনা থেকে বিরত থাকছেন ভোক্তার একটা বিরাট অংশ। তারপরও আমিষের চাহিদা মেটাতে মুরগির ওপর নির্ভর করতেন সাধারণ মানুষ। উপায় না থাকায় আমিষের চাহিদা মেটাতে মুরগির গিলা-কলিজাই এখন একমাত্র ভরসা সাধারণ ও নিম্ন আয়ের মানুষের।
নয়াশতাব্দী/টিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ