শরীয়তপুর সদর উপজেলার একটি বিদ্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতনের টাকা আদায় করার অভিযোগ উঠেছে। উপবৃত্তি প্রাপ্ত দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বেতন মওকুফ করা ও তাদের কাছ থেকে তা আদায় না করার নিয়ম রয়েছে। অথচ এই নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না চিতলিয়া সমিতির হাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। বেতন আদায়ের জন্য শিক্ষার্থীদের চাপ প্রয়োগ ও উপবৃত্তির টাকা থেকে বেতনের টাকা আদায় করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
জেলা শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার খরচ যোগান দিতে সরকার প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট হতে সমন্বিত উপবৃত্তি কর্মসূচির আওতায় উপবৃত্তি প্রদান করে। ষষ্ঠ শ্রেণি হতে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বছরে দুই কিস্তিতে উপবৃত্তির টাকা দেয়া হয়। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাসে ২০০ টাকা, অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ২৫০ টাকা, নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ৩০০ টাকা করে উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। উপবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো টিউশন ফি (মাসিক বেতন) আদায় করা যাবে না বলে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট হতে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। উপবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের মাসিক বেতন ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির জন্য ৩৫ টাকা হারে ও নবম-দশম শ্রেণির জন্য ৫০ টাকা হারে টাকা প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট হতে বিদ্যালয়ে প্রদান করা হয়।
কিন্তু সরকারের এ আদেশ উপেক্ষা করে শরীয়তপুর সদর উপজেলার চিতলিয়া সমিতির হাট উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯২ জন উপবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাসিক বেতন আদায় করা হচ্ছে। ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাসিক বেতন হিসেবে ১৮০ টাকা, সপ্তম শ্রেণির ২০০ টাকা, অষ্টম শ্রেণির ২২০ টাকা, নবম শ্রেণির ২৬০ টাকা ও দশম শ্রেণির ৩০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। এ ছারা ভর্তি ফি, সেশন ফি, বিদ্যুৎ বিল, বিদ্যুৎ সামগ্রী ক্রয়, খাজনা, পরিচ্ছন্নতা, স্টেশনারি, অফিস সামগ্রী, উন্নয়ন, অনলাইন ও ইন্টারনেটের খাত দেখিয়ে বাড়তি টাকা আদায় করা হচ্ছে।
সদর উপজেলার চিতলিয়া সমিতির হাট উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অধিকাংশ শিক্ষার্থী দরিদ্র ও শ্রমজীবীদের সন্তান। তাদের পক্ষে বিদ্যালয়ের দাবিকৃত টাকা পরিশোধ করা কষ্টসাধ্য। প্রধান শিক্ষক হারুন অর রশিদ শিক্ষার্থীদের অফিস কক্ষে ডেকে ও শ্রেণি কক্ষে গিয়ে টাকা আদায়ের জন্য বিভিন্ন সময় চাপ দেন। টাকা না দিলে বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করা যাবে না এমন কথাও তিনি শিক্ষার্থীদের বলে থাকেন।
বুধবার চিতলিয়া সমিতির হাট উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ১৯৯৪ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে বিদ্যালয়ে ৩৮৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।
দুই কিলোমিটার দূরত্বে পশ্চিমপাড় গ্রাম থেকে অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসে। তার বাবা একজন দরিদ্র কৃষক। তারা ৪ বোন। তিন বোন পড়ালেখা করে। দরিদ্র পরিবারের পক্ষে তিন বোনের পড়ালেখার খরচ চালানো কষ্টসাধ্য। তাকে মাসিক বেতন ও আনুসঙ্গিক খরচসহ বছরে ৫ হাজার ২৮০ টাকা দিতে হয়। অথচ সে বছরে উপবৃত্তির টাকা পায় ৩ হাজার।
ওই শিক্ষার্থী বলেন, আমার বাবা কৃষি কাজ করে সংসার চালান। তিন বোন পড়ালেখা করছি। অনেক খরচ। আমি উপবৃত্তির কিছু টাকা পাই। যা পাই তার দ্বিগুণ স্কুলে রেখে দেয়। টাকা দিতে না পারলে প্রধান শিক্ষক চাপ দেন। বাধ্য হয়ে স্কুলের ধায্যকৃত টাকা দিতে হয়।
এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, স্কুলে পড়ালেখার জন্য সরকার উপবৃত্তির টাকা দেয়। আবার ওই শিক্ষার্থীর স্কুলের বেতন সরকার স্কুল ফান্ডে দিয়ে দেয়। তারপরও স্কুল কর্তৃপক্ষ ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে বেতন আদায় করেন। সরকার সকল খরচ দেয়ার পরও কেন এভাবে আমাদের অর্থনৈতিক চাপে রাখা হয়?
জানতে চাইলে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক হারুন অর রশিদ বলেন, কোনো শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পায় তা আমরা সুনির্দিষ্টভাবে জানি না। অনেকে উপবৃত্তি পাওয়ার তথ্য গোপন করে রাখে। তখন অনেকের কাছ থেকে মাসিক বেতন নেয়া হয়। আমরা জানতে পারলে উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন আদায় করি না। তাদের কাছ থেকে বেতন ছাড়া বিদ্যালয়ের অন্যান্য পাওনা আদায় করা হয়।
শরীয়তপুর জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শ্যামল চন্দ্র শর্মা বলেন, উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মাসিক টিউশন ফি সরকার স্কুলগুলোকে প্রদান করে। কোনো স্কুল ওই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায় করতে পারবে না মর্মে পরিপত্র জারি করা আছে। স্কুল কর্তৃপক্ষও তা জানে।
প্রধান শিক্ষক বলেছেন, কারা উপবৃত্তি পায় তার তালিকা স্কুলে নেই। তার এমন দাবির সাথে আপনি এক মত কিনা? এমন প্রাশ্নের জবাবে শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ওই শিক্ষকের এমন দাবি সঠিক নয়। অবশ্যই তালিকা বিদ্যালয়ে থাকবে। ওই তালিকা বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা ও নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দেয়ার বিধান রয়েছে।
শরীয়তপুর সদর উপজেলা শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাজাহারুল ইসলাম বলেন, উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো বেতন নেওয়ার বিধান নেই। আমি নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। পরবর্তীতে কোনো বিদ্যালয় যেন উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন আদায় না করে সেদিকে খেয়াল রাখা হবে।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) শামসুন নাহার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতনের টাকা আদায় করা হয় এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো। প্রমাণ পেলে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নয়া শতাব্দী/এসএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ