‘ছোট সম্রাট’ বললে এক নামে চেনে রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ির মানুষ। আঠারো পেরিয়ে উনিশে পা দেওয়া এই যুবক মাদকের বড় কারবারি। ইয়াবা বেচাকেনা করছে কলঘর বাজারে– এমন তথ্যে গত ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে দলবলে হানা দেয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।
এ অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন কক্সবাজার কার্যালয়ের ইন্সপেক্টর শফিকুল ইসলাম ও সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) তায়রিফুল ইসলাম। এসময় অভিযান চালিয়ে ব্যাগভর্তি ইয়াবাসহ মাদক সম্রাট ছোটনকে তার এক রোহিঙ্গা সহযোগীসহ আটক করে নিয়ে যান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। জব্দ করা হয় মাদক পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটিও।
পরদিন ওই দুজনের নামে করা মামলার এজাহারে তাদের কাছ থেকে ২৮৭ পিস ইয়াবা জব্দ দেখানো হয়। আর মোটরসাইকেলটি তড়িঘড়ি করে ভোর রাতেই দিয়ে দেওয়া হয় ছোটনের পরিবারের সদস্যদের।
প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, এই এক ঘটনাতেই বিপুল ইয়াবা গায়েব করেন শফিকুল-তায়রিফুল ও তাদের দলবল।
একই দিন ফঁতেখারকুল ইউনিয়নের দক্ষিণ শ্রীকুলের মাদক মাফিয়া আব্দুর রহিমকে আটক করা হয়। এসময় তার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ মাদক জব্দ করলেও মাত্র ৬০০ পিস ইয়াবা উদ্ধারের মামলা করেন মাদক কর্মকর্তারা। চিহ্নিত এই মাদক কারবারিকে মাত্র ৬০০ পিস ইয়াবা দিয়ে জেল হাজতে পাঠানোর ঘটনা রীতিমত বিস্মিত করেছে এলাকাবাসীকে। এমনই দাবি করছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
একজন দুর্ধর্ষ মাদক কারবারিকে ব্যাগভর্তি ইয়াবাসহ আটক করার পর, তার কাছ থেকে মাত্র ১১২ পিস ইয়াবা উদ্ধারের লুকোচুরিতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। রফাদফার পর উৎকোচের বিনিময়ে প্রথমে মোটরসাইকেলটি ছেড়ে দিয়ে অল্প ইয়াবা জব্দ দেখান ডিএনসি। এমন অভিযোগ প্রত্যক্ষদর্শীদের।
তাদের মতে, ১০ থেকে ২০ হাজারের বেশি ইয়াবা জব্দের বিপরীতে ডিএনসির করা মামলায় মাত্র ২৮৭ পিস ইয়াবা দেখানো হয়। এমনকি জব্দ তালিকা তৈরির সময় ইয়াবা নিয়ে শুরু হয় মাদক কর্মকর্তা ও সোর্সদের হরিলুট। ফলে এ ঘটনায় গত কয়েকদিন দিন ধরে কলঘরের স্থানীয় জনতা ও খোদ ছোটনের পরিবারসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় পরিলক্ষিত হচ্ছে নানা কানাঘুষা।
ছোটন দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের সদস্য উমখালী এলাকার মেম্বার আমির হামজার ছেলে। তার সহযোগী জাকারিয়া টেকনাফের হোয়াইক্যাং আমতলি এলাকার পুরাতন রোহিঙ্গা কালুর ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, ছোটন দক্ষিণ মিঠাছড়ি এলাকার চিহ্নিত মাদক কারবারি। সে এলাকায় নিত্য নতুন মোটরসাইকেলযোগে ঘুরে বেড়ান। ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতার সঙ্গে তার বাবা আমির হামজা মেম্বারের বন্ধুত্ব। এলাকায় তিনি একজন প্রভাবশালী হিসাবে পরিচিত।
নির্ভরযোগ্য প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রমতে, গত ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৭দিকে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রামু কলঘর বাজার এলাকার ‘স্বাদ কনফেকশনারি অ্যান্ড বেকারি’র পশ্চিম পাশের একটি পানের দোকানের সামনে একটি নতুন মোটরসাইকেলে চড়ে দোকানটির সামনে দাঁড়ান ছোটন ও জাকারিয়া। হাতে ছিলো একটি কালো ব্যাগ। যা ছিলো ভর্তি। তাদের ব্যাগভর্তি ইয়াবাসহ আটক করে রামুর দিকে নিয়ে যান মাদক কর্মকর্তা শরিফুল ও এসআই তায়রিফুলসহ তাদের সঙ্গীয় ফোর্স। এসময় সেখানে চারপাশের লোকজন জড়ো হলে সেই ব্যাগ খুলে ইয়াবাগুলো দেখান প্রত্যক্ষদর্শীদের।
আটকের পর মাদক কর্মকর্তারা মোটরসাইকেলসহ ওই দু’জনকে তাদের কার্যালয়ে না নিয়ে রামুর দিকে নিয়ে যান। এরপর মাদক কারবারি ছোটনের পরিবারের সঙ্গে দর কষাকষি করতে থাকেন। প্রথমে ৫ লাখ, পরে পর্যায়ক্রমে লক্ষাধিক টাকা উৎকোচের বিনিময়ে গাড়িটি ছেড়ে দেওয়া ও জব্দ তালিকায় নামমাত্র ইয়াবা উদ্ধার দেখানোর চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী, ছোটনের সহযোগী রোহিঙ্গা জাকারিয়ার কাছ থেকে ১৭৫ ও মাদক সম্রাট ছোটনের কাছ থেকে ১১২ পিস ইয়াবা জব্দের ঘটনায় রামু থানায় মামলা করেন মাদকদ্রব্যের কর্মকর্তারা।
একই দিনের দুটি অভিযানে মাদক নিয়ে কাজ করা সংস্থাটির কর্মকর্তারা অপরাধীর পক্ষ নেওয়া এবং জব্দ করা মাদক গায়েব করা নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীসহ স্থানীয়দের মাঝে চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে।
সাইফুল ইসলাম, আয়াছ, আলম, নজিবুলসহ অন্তত ১০ থেকে ১২ জন প্রত্যক্ষদর্শী অভিযোগ করে বলেন, ছোটন ও তার সঙ্গে থাকা এক ব্যক্তিকে আটক করার সময় তাদের হাতে একটি ব্যাগ ছিল। এসময় বাজারে উপস্থিত লোকজন এগিয়ে আসলে, অভিযানকারীরা মাদকদ্রব্যের লোকজন পরিচয় দিয়ে তাদের আটকের কারণ হিসেবে ব্যাগ খুলে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা দেখান। পরদিন রামু থানায় তাদের নামে করা মামলায় ছোটনের কাছে ১১২ এবং তার সঙ্গে থাকা ব্যক্তির কাছে ১৭৫ পিস ইয়াবা পেয়েছে বলে যে নাটক সাজিয়েছে, তাতে বুঝতে বাকী থাকেনা যে, এতবড় ইয়াবার চালানটি মাদকদ্রব্যের লোকজনই গায়েব করেছেন।
তারা আরও বলেন, ২৮৭ পিস ইয়াবা বহন করতে ব্যাগ ব্যবহার করবে এটি পাগল আর শিশুও বিশ্বাস করবে না। দুজন ব্যক্তি চাইলে তাদের প্যান্ট-শার্টের পকেটে খুব সহজেই ৩ থেকে ৪শ পিস ইয়াবা বহন করতে পারে। এত অল্প ইয়াবা বহন করতে অযথা একটি ব্যাগ ব্যবহারের ঘটনা হাস্যকর।
তাদের মতে, মাদকের পরিমাণ কম দেখাতে, জামিন কিংবা আইনী জটিলতা সহজ করতে ছোটনের পরিবারের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকার চুক্তিতে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন। অভিযানে জব্দ করা মাদক নামমাত্র প্রকাশ করে বাকীগুলো নিজেরাই তাদের সোর্সের মাধ্যমে বিক্রি করে ডিএনসির কথিত অসাধু কর্মকর্তারা দেদার মাদক কারবার করছে বলেও অভিযোগ প্রত্যক্ষদর্শীদের।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, র্যাব, কোস্টগার্ড, পুলিশ ও বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বড় বড় মাদকের চালান জব্দ করে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং করতে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণের কাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত এ সংস্থাটির চেয়েও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত পুলিশ ও র্যাব-ই এ কাজটি বেশি করছেন। মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করা এই সংস্থাটির একটি মিডিয়া সেল থাকলেও সেখানে নিয়মিত আপডেট দেওয়া হয় না। তাদের অধিকাংশ জব্দ তালিকা ১শ থেকে হাজার পিসেই সীমাবদ্ধ। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বড় চালান জব্দ করার নজির তেমন একটা নেই সংস্থাটির।
সচেতন মহলের অভিযোগ, মাদক নির্মূলে পুরোপুরিভাবে দায়িত্ব পালন করার কথা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের। কিন্তু তারা তা না করে জব্দ করা মাদক গায়েব করতে ব্যস্ত হয়ে থাকেন সবসময়। বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব নানা কাজের মধ্যেও মাদক নির্মূলে ভালোই কাজ করছে।
মাদক নির্মূল করতে গিয়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। আসামি ও তাদের স্বজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে অনৈতিক সুবিধা দিচ্ছেন– কারও কারও বিরুদ্ধে রয়েছে এমন অভিযোগও। কেউ কেউ অবৈধভাবে বিক্রি করে দিচ্ছেন জব্দ করা মাদক। টাকার বিনিময়ে ভুয়া সাক্ষী, মামলার এজাহারে নয়-ছয়, ইয়াবাসহ গ্রেপ্তারের পর টাকার বিনিময়ে ছেঁড়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
এসবের কিছু ঘটনা প্রকাশ্যে এলেও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নজির খুব একটা নেই। অপরাধ করেও পার পাচ্ছেন অনেক ‘প্রভাবশালী’ কর্মকর্তা। তথ্যানুসন্ধানে মিলেছে এসব তথ্য।
তবে ডিএনসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তদন্ত করা হয়। প্রমাণ পেলে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।ডিএনসি সূত্র জানিয়েছে, কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে নামকাওয়াস্তে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শাস্তি হিসেবে কারও হয় ইনক্রিমেন্ট স্থগিত, কাউকে করা হয় তিরস্কার। কেউ কেউ পেয়ে যান অব্যাহতি। এ কারণে চিহ্নিত মাদক কারবারিকে হাতেনাতে মাদক-অস্ত্রসহ আটক করে নিজেরাই বাদী হয়ে মামলা করে। পরে ওই আসামিকে নির্দোষ বলে চার্জশিট দেওয়ার মতোও দুঃসাহস দেখাতেও পিছপা হন না কেউ কেউ।
জানতে চাইলে অভিযানে নেতৃত্বে দেওয়া ইন্সপেক্টর শফিকুল ইসলাম এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীরা অনেক সময় সবকিছু ভালো করে বুঝতে পারে না। সাক্ষীদের উপস্থিতে ইয়াবাগুলো জব্দ করা হয়েছে। এছাড়াও জব্দ করা আলামতসহ অনেক কিছু এখনো আমাদের অফিসে রয়েছে; চাইলে দেখাতে পারবো। যা আপনার বিশ্বাস হবে।
২৮৭ পিস ইয়াবা বহনের জন্য একটি ব্যাগ ব্যবহার করবে- এটা বাস্তবসম্মত কি-না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাদক ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময় নানা কৌশল বেছে নেন বলে দাবি করেন এই কর্মকর্তা।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, ওই ব্যাগটি ভর্তি ছিলো একথা সত্য। তবে সেগুলো ছিলো ডাল। ডালের ভেতরে সামন্য কিছু ইয়াবা পাওয়া গেছে। ওই অভিযানকালে সঙ্গে থাকা শফিকুল ইসলাম আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সৎ কর্মকর্তা।
তার উপস্থিতিতে এমন হওয়ার কথা নয় বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
নয়াশতাব্দী/এনএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ