ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

টানা ছুটিতে কক্সবাজার সৈকতে পর্যটকের ঢল, সতর্ক প্রশাসন

প্রকাশনার সময়: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৮:১৩ | আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:১৩

ভাষা দিবস ও সপ্তাহিক মিলিয়ে পাওয়া ছুটিকে কাজে লাগিয়ে কক্সবাজার সৈকতে বেড়াতে এসেছেন লাখো ভ্রমণ পিপাসু। শীতের শেষ, বসন্ত শুরুর গরম ও রাতের হিমশীতল ছোঁয়া নিতে আসা পর্যটকে সরগরম হয়েছে সৈকত নগরীর বালিয়াড়ি ও পর্যটন স্পটগুলো।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটকের পাশাপাশি, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ছুটির সঙ্গে সপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসছেন স্থানীয়রাও।

মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাত থেকেই শুরু হয় পর্যটকদের আসা। মৌসুমের শেষ সময়ে জমজমাট ব্যবসার হাতছানিতে খুশি পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। যে যার অবস্থান থেকে পর্যটকদের সেবা দিতে চেষ্টা করছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আগাম বুকিং হয়েছে কক্সবাজারের সাড়ে ৪শ হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস, কটেজসহ আবাসনস্থলে। ৫০ শতাংশ রুম আগেই বুকিং ছিল। যা কিছু খালি আছে, তাও মঙ্গলবার-বুধবার নিচ্ছেন ওয়াকিং গেস্টরা। রাত অবধি ৮০ ভাগ রুম পর্যটকে ভরে যাবে- এমনই আশা হোটেল কর্তৃপক্ষের।

মৌসুমের শেষ দিকের টানা এ ছুটিতে সৈকতের বালিয়াড়িতে যে তিল ধারণের ঠাঁই নেই অবস্থা।

শুধু হোটেল ও বালিয়াড়ি নয়, পর্যটন স্পট ইনানী, সেন্টমার্টিন, হিমছড়ি, সোনাদিয়া, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, টেকনাফের মাথিনের কূপ, কদুম গুহা, রামুর রামকোট, একশ ফুট সিংহশয্যা বৌদ্ধমূর্তি দেখতেও ভিড় জমাচ্ছেন পর্যটকরা। সমান তালে যাচ্ছেন বার্মিজ মার্কেট ও শুটকী মহালে।

বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সৈকতে গিয়ে দেখা যায়, বালিয়াড়িতে আসা আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা ঢেউয়ের সান্নিধ্য নিতে গোসলে নেমেছে। বিচ চেয়ার কিংবা বালিতে বসে সুখ-দুঃখের অনুভূতি শেয়ার করছেন স্থানীয় পর্যটকরা। আবার কেউ হাঁটছেন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত।

পর্যটন সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০০০ সালের শুরু থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে থার্টিফার্স্ট নাইট তথা ইংরেজি বর্ষকে বিদায়-বরণ ও জানুয়ারির শীতকালীন ছুটির অবকাশ যাপনে কক্সবাজারে আসতো লাখ লাখ পর্যটক। কিন্তু রামু ট্রাজেডির পর এ নিয়ম পাল্টে যায়। নানা আশঙ্কায় তখন থেকে থার্টিফার্স্ট নাইট পালনে ধরাবাধা নিয়ম করে দেয় প্রশাসন। মৌসুমের এ সময়টা তাই আগের মতো আর জমে না।

তবে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ইস্যুর পর থেকে সারা বছরই দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারি নানা পর্যায়ের কর্মকর্তা মিলে দারুণ সরব পর্যটন জোনের সকল ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান। অনেক গেস্ট হাউস ও ফ্লাট পুরো মাসের জন্য বুকিং নিয়ে অফিস কার্যক্রম চালাচ্ছে এনজিও প্রতিষ্ঠান।

হোটেলগুলো কমবেশি নিত্যদিন ব্যবসা করলেও বেশিরভাগ রুম খালি থাকত। তবে, সপ্তাহিক ছুটিসহ অন্য ছুটি এক হলে, পর্যটকে টইটম্বুর হয়ে উঠছে কক্সবাজার।

তেমনি এবারের ভাষা দিবসের ছুটির সঙ্গে সপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে টানা কয়েকদিন জমজমাট সৈকত নগরী। বুধবার সকাল থেকে জেলার পর্যটন স্পটগুলো দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন ভ্রমণপিপাসুরা। এতোদিন তাদের জন্য বাড়তি আনন্দ হিসেবে ছিল পর্যটন গলফ মাঠে চলমান শিল্প ও বাণিজ্য মেলা।

রাজপ্রাসাদের গেইটের আদলে গড়া প্রবেশদ্বার ও শতাধিক নানা পণ্যের বাণিজ্যিক দোকান পর্যটকদের মনের খোরাক মিটিয়েছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে স্থানীয় ভ্রমণ পিপাসুদের পাশাপাশি দূরের পর্যটকরাও মেলায় ঘুরে এটা, ওটা কিনতেন বলে জানান মেলার প্রধান সমন্বয়ক সাহেদ আলী শাহেদ। যা মঙ্গলবারই শেষ হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতায় চলতি পর্যটন মৌসুম চললেও কক্সবাজারে পর্যটক উপস্থিতি আশানুরূপ ছিল না।

তার ওপরে নাইক্ষ্যংছড়ি-উখিয়া-টেকনাফে মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে সাম্প্রতিক সংঘাত ও নাফ নদীতে নাব্য সঙ্কটে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-পথে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ এবং স্বল্প ব্যয় ও সহজ পথে সেন্টমার্টিন ভ্রমণ বন্ধ থাকায়, কক্সবাজারে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পর্যটক উপস্থিতি নেই বললেই চলে।

ফলে, গেস্ট হাউজ, কটেজ ও ননস্টার হোটেলগুলো ফাঁকাই যাচ্ছে মৌসুমের বেশিরভাগ সময়। গত বিজয় দিবসের ছুটির দিনে সপ্তাহিক বন্ধের দিন পড়ায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পর্যটকের উপস্থিতি হয়নি। এতে চরম হতাশায় সময় কেটেছে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের।

কিন্তু সেই হতাশায় আলো দেখাচ্ছে এবারের ভাষা দিবসের ছুটি। সপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে ভাষা দিবসের ছুটি এক হওয়ায়, টানা ছুটির সুযোগকে কাজে লাগাতে ভ্রমণপ্রেমীরা কক্সবাজার আসছেন। এ উপলক্ষ্যে আগাম বুকিং নিয়েছেন হোটেল-মোটেল ও কটেজ কক্ষ। ব্যয়বহুল জেনেও অনেকে আগাম টিকিট কেটেছেন কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে চলা কর্ণফুলী ও বারো আউলিয়া জাহাজের টিকিট। সেন্টমার্টিনেও এবারে আগাম কিছু বুকিং পেয়েছে সেখানকার হোটেল ব্যবসায়ীরা।

কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে আসা পর্যটক দম্পতি আতিকুর রহমান সম্রাট ও আনিকা আমিন জানান, দীর্ঘদিন কোথাও যাওয়া হয়নি। তাই ভাষা দিবসের ছুটিসহ টানা বন্ধ পেয়ে বাড়ির সবাইকে নিয়ে কক্সবাজার এসে পাঁচ তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইসে উঠেছি। আমাদের মতো আরো অনেকে এসেছেন বেড়াতে, হোটেলের প্রায় সব রুমে মানুষের উপস্থিতি তেমনটি মনে হচ্ছে।

এদিকে, পর্যটকবাহী অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ পড়েছে মহাসড়কে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়া, চন্দনাইশ, দোহাজারি, কেরানিহাট, পদুয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, লিংকরোড় ও বাস টার্মিনাল এলাকায় পড়া জ্যামে কাহিল হচ্ছেন পর্যটকসহ সাধারণ যাত্রীরা।

ঢাকার বনশ্রী থেকে পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসা ইয়াছিন হোসেন জানান, কাজের চাপে পরিবারকে সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না। ভাষা দিবসের সঙ্গে সাপ্তাহিক মিলিয়ে টানা চারদিন ছুটি পেয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে সৈকতে এসেছি।

আগের কক্সবাজারের সঙ্গে বর্তমানের কক্সবাজারের তফাৎ অনেক জানিয়ে তিনি বলেন, এখন অবকাঠামোর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। গরম শুরু হওয়ায় পর্যটক কম আসবে বলে ধারণা করেছিলাম। কিন্তু বালিয়াড়িতে ধারণার চেয়েও অধিক পর্যটক এসেছে।

এদিকে, পর্যটকদের আনন্দকে পুঁজি করে কিছু কিছু হোটেল-মোটেল-রেঁস্তোরায় গলাকাটা দাম নেওয়ার অভিযোগ ওঠে প্রায়ই। এবারও তেমনটি হবে ভেবে আগাম সতর্কাবস্থায় রয়েছে জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেল। কোনো হোটেল কক্ষের ভাড়া অতিরিক্ত নেওয়া বা রেঁস্তোরাগুলো মাত্রাতিরিক্ত টাকা আদায় করছে বলে মনে হলে, প্রতিটা হোটেলের লবিতে টাঙানো পর্যটন সেলের নম্বরে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেছেন সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইয়ামিন হোসাইন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হোটেল সংশ্লিষ্টরা জানান, দালালদের সঙ্গে ৫০ শতাংশ ভাগাভাগির চুক্তি থাকায় বাধ্য হয়ে পর্যটকদের কাছ থেকে বেশি দাম নিতে হয় হোটেল ব্যবসায়ীদের। এতে পর্যটকরা বিড়ম্বনার শিকার হন বলেও উল্লেখ করেন তারা।

সী-নাইট গেস্ট হাউসের ব্যবস্থাপক শফিক ফরাজী জানান, এ বছরের পর্যটন মৌসুম সবার ভালো কেটেছে। গত কয়েকদিন থেকে টানা বুকিং রয়েছে আমাদের। কোয়ালিটি মেনটেইন করে সব সময় একই দাম রাখার চেষ্টা করি আমরা। কেউ কেউ হয়তো প্রয়োজনকে পুঁজি করে নীতি বির্সজন দিয়ে বদনাম কুড়ায়।

কক্সবাজার হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাখাওয়াত হোসেন বলেন, তারকা হোটেলগুলোর রুম ভাড়া পুরো বছরই এক। তার ওপর মৌসুম ভেদে ডিসকাউন্ট থাকে। কিন্তু নন স্টার হোটেলগুলো চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে কম-বেশি দাম আদায় করে বলে অভিযোগ শুনি। পর্যটনের স্বার্থে এটা বন্ধ হওয়া দরকার।

কক্সবাজার গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, টানা ছুটি থাকলে ভ্রমণ পিপাসুরা আগাম হোটেল কক্ষ বুকিং করেন। এবারও তেমনটি হয়েছে। প্রায় ৫০-৬৬ শতাংশ রুম বুকিং হয়েছে আগেই। আর বাকিটা কয়েকদিন থেকে হওয়া শুরু হয়েছে। আগামী মার্চ পর্যন্ত কক্সবাজারের সর্বত্র জমজমাট থাকবে এমনটি আশা আমাদের।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তায় নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে সিসিটিভি ক্যামেরা বাড়ানোর পাশাপাশি ড্রোন দিয়ে পুরো সৈকত এলাকা মনিটরিং করা হচ্ছে।

এছাড়াও পর্যটকদের নিরাপত্তায় সৈকত ও আশপাশে পোশাকধারী পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। সৈকতে বাইক নিয়েও টহল চলছে। রয়েছে ৩টি বেসরকারি লাইফ গার্ড সংস্থার অর্ধশতাধিক প্রশিক্ষিত কর্মী। কন্ট্রোল রুম, পর্যবেক্ষণ টাওয়ারসহ পুরো সৈকত পুলিশের নজরদারির আওতায়।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, পর্যটকদের সুবিধার্থে সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা, কলাতলীসহ প্রতিটি পয়েন্টে তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। পর্যটক হয়রানি বন্ধে মাঠে থাকছে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত। কোথাও পর্যটক হয়রানির অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, পর্যটকদের অনাকাঙ্খিত হয়রানি রোধে পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে এবং পর্যটক বেশেও পুলিশের নারী সদস্য সৈকতে ঘুরছেন। সব মিলিয়ে পর্যটক নিরাপত্তায় সবসময় সর্তকাবস্থায় রয়েছি আমরা।

নয়া শতাব্দী/এসএমআর/এনএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ