ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইঁদুরের গর্তের ধান সংগ্রহ বিচিত্রময় মৌসুমি পেশা

প্রকাশনার সময়: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:২৯

ইঁদুরের গর্তে জমানো ধান ও ফসল যার আর্থিক মূল্য প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। এই বিশাল অংকের আর্থিক মূল্যের অপচয় রোধ করছে বিচিত্রময় পেশার নর-নারী ও কিশোর-কিশোরীরা। মাটির গর্তে ইঁদুর ধান ও দানাদার শস্য জাতীয় ফসল লুকিয়ে রাখে। সেই ফসল মাটি হতে তুলে বিচিত্র পেশার মানুষ।

ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা, কালাই জাতীয় দানাদার শস্য পাকলে সেই জমিতে ইঁদুরের উপদ্রপ বেড়ে যায়। ইঁদুর জমিতে বিশাল বিশাল গর্ত খুঁড়ে তাতে শস্য জাতীয় ফসল লুকিয়ে রাখে। যার অর্থনৈতিক মূল্য নেহাত কম নয়, প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। গ্রাম-গঞ্জে ফসল কেটে নেয়ার পর দরিদ্র পরিবারের কিশোর-কিশোরী ও নারী-পুরুষ মাটির গর্তে ইঁদুরের লুকিয়ে রাখা ফসল উদ্ধার করতে দেখা যায়। অনেকে এটাকে মৌসুমি জীবিকা হিসেবে নিয়েছে। আপাতত দৃষ্টিতে এটা নিছক শখের পেশা হলেও যার সমষ্টি গত অর্থনৈতিক মূল্য অনেক। কৃষি বিভাগের এক তথ্যে যার বাজার মূল্য প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। তাইতো শত শত বছর ধরে উত্তরাঞ্চলের গ্রামে ইঁদুরের গর্তের শস্য উত্তোলনে এমন বিচিত্র পেশার মানুষকে দেখা যায়। এই পেশার কারণে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে প্রতি বছর প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ফসল রক্ষা পাচ্ছে। এতে দরিদ্র পরিবারের সদস্যরা একদিকে যেমন নিজেরা ফসল চাষ না করেও প্রতি বছর পতিত ফসল রক্ষা করে আর্থিক সচ্ছলতা অর্জন করছে। অন্যদিকে বিশাল অংকের জাতীয় সম্পদ রক্ষায় ভূমিকা রাখছে।

এই বিচিত্র পেশার মানুষের কারণে ইঁদুরের গর্তে শতশত মন ধান, গম ও দানাদার জাতীয় ফসল মাটির নিচে পচে যাওয়া হতে রক্ষা পাচ্ছে। তাই ইঁদুরের গর্তে লুকিয়ে রাখা শস্য সংগ্রহের বিচিত্র পেশাকে অর্থনৈতিকভাবে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে ইঁদুর বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ফসল নষ্ট করে থাকে। ইন্ডাষ্ট্রিয়াল অপচয়ের পরিমাণ এর চেয়ে অনেক গুণ বেশি। তাই প্রতি বছর জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান সপ্তাহ পালন করে থাকে কৃষি মন্ত্রণালয়। ইঁদুর নিধনে সফল মানুষ ও প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। এ তথ্য নিশ্চিত করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

প্রতিনিয়ত ইঁদুর কৃষকের কষ্টার্জিত ফসলের কয়েক গুণ নষ্ট করে থাকে। এ ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। গত বছর প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ ৮৪ হাজার ইঁদুর নিধনের মাধ্যমে প্রায় ৮৯ হাজার ৮৭৬ মেট্রিক টন ফসল রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, ২০১৯ সালেও ইঁদুর নিধন অভিযানের মাধ্যমে প্রায় ১ কোটি ৪৭ লাখ ৯০ হাজার ইঁদুর নিধন করে ৩০০ কোটি টাকার ফসল রক্ষা করা হয়েছিল। ইঁদুরের ব্যাপক ক্ষতি থেকে ফসলকে রক্ষা করার পাশাপাশি ইঁদুর নিধন কার্যক্রমকে আরও জোরদার করার আহ্বান চলমান রয়েছে কৃষি বিভাগের।

এদিকে কৃষি বিভাগের সূত্র মতে, দেশের উত্তরাঞ্চলে জেলাগুলোতে ইঁদুরের গর্তে লুকিয়ে রাখা দানাদান শস্য জাতীয় ফসল ধান, গম ও ডাল উদ্ধারে স্বেচ্ছায়প্রণোদিত হয়ে একশ্রেণির নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী প্রতি বছর কৃষি ফসলের মাঠে কাজ করছে। কোনো কোনো সময় কৃষক নিজেও মাটি খুঁড়ে ফসল উদ্ধার করে থাকে। সাধারণত লালমনিরহাট জেলায় গ্রামে-গঞ্জে শীত মৌসুমে ধান, গম, সরিষা, ভুট্টা ও কালাই খেত কেটে নেয়ার পর পরিত্যক্ত ফসলের মাঠের ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে ফসল উদ্ধার করে থাকে। এই সময় যারা ফসল উদ্ধার করে তারাই উদ্ধারকৃত ফসলের মালিক হয়ে যায়। জমির মালিক বা বর্গাচাষিকে সেই উদ্ধারকৃত ফসলের কোনো অংশ দিতে হয় না।

ইঁদুরের উপদ্রব বেশি হলে উল্টো ইঁদুর নিধনে গর্ত খুড়ে ইঁদুর মেরে ফেলার জন্য প্রতি ইঁদুরে ১০ টাকা করে পারিশ্রমিক দিয়ে থাকে। ইঁদুর মারায় পারর্দশীদের গ্রামে বিশেষ কদর রয়েছে। এদিকে দেখা গেছে ধান কেটে আনার মৌসুমে গ্রামে নানা ধরনের সদাই-পাতি নিয়ে ফেরিওয়ালা আগমন ঘটে। তখন গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে থাকে ধান। ধানকে বিনিময় মূল্য ধরে গ্রামের নারীরা সদাই-পাতি ও দৈনন্দিন সামগ্রিক ক্রয় করে থাকে। গ্রামে এই সময় মলা, মুড়ি, মুড়কি ফেরি করে বিক্রি করতে দেখা যায়। এই মুড়ি, মুড়কি ফেরিওয়ালা কাছ হতে কিনে খেতে গ্রামের কিশোর-কিশোরী ইঁদুরের গর্তে লুকিয়ে রাখা ধান-গম উদ্ধার করতে দেখা যায়। তারা দল বেধে পরিত্যক্ত ফসলের মাঠে গর্তের মাটি সরিয়ে ধান উদ্ধার করে ফেরিওয়ালাকে দিয়ে বিনিময়ে মলা, মুড়ি, মুড়কি, বাতাসা, খুরমা নিয়ে থাকে। কেউ কেউ এই ইঁদুরের গর্তে লুকিয়ে রাখা ধান সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে খাতা, কলম, পেন্সিলসহ নিজের ব্যক্তিগত খরচ মিটিয়ে থাকে। এতে পরিবার কিছুটা হলেও আর্থিক সাশ্রয় পায়।

কেউ কেউ এই ইঁদুরের গর্তে লুকিয়ে রাখা ধান সংগ্রহকে জীবিকা হিসেবে মৌসুমি পেশা করেছে। তেমনি একজন কৃষি শ্রমিক জান্নাতি বেগম- তিনি জানান, আমন ধান কেটে নিয়ে গেলে পরিত্যক্ত কৃষি জমিতে পড়ে থাকা ধানের শীর্ষ ও ঝরে পড়া ধান কুড়াই। এই সময় জমিতে ইঁদুরের গর্তে লুকিয়ে রাখা ধান সংগ্রহ করে থাকি। প্রতিদিন এভাবে ধান সংগ্রহ করতে গিয়ে গড়ে এক মন ধান উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এতে ৫/৭ টাকা দৈনিক হাজিরা পড়ে যায়। পরিশ্রম ও কায়িকশ্রম কম হয়। ধানের মৌসুমে প্রায় এক মাস এই মৌসুমি ইঁদুরের গর্তেরধান সংগ্রহের পেশা চলে।

তিনি আরও বলেন, ইঁদুরের গর্তে লুকিয়ে রাখা ধান ও গম সংগ্রহে জমির মালিক বাধা দেয় না। বরং তারা উৎসাহিত করে থাকে। কারণ গর্তে লুকিয়ে থাকা ইঁদুর ধান সংগ্রহের সময় মারা পড়ে এতে ইঁদুরের হাত হতে পরের ফসল রক্ষা হয়। দ্বিতীয়ত ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে নিচের মাটি উপরে ও উপরের মাটি নিচে যায়। এতে জমির মাটির উর্বরা শক্তি বাড়ে। তাই ইঁদুরের গর্তে লুকিয়ে রাখা ধান সংগ্রহের পেশার কৃষি অর্থনৈতিক মূল অনেক। ফসল রক্ষা, সম্পদ অপচয় রোধ ও জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

নয়া শতাব্দী/এসএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ