জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) পণ্যের স্বীকৃতি মিললেও নানা প্রতিবন্ধকতায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না শত বছরের বেশি সময়কাল ধরে ঐতিহ্যবাহী কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা। সম্ভাবনা সত্ত্বেও প্রসার ঘটছে না এই ক্ষুদ্রশিল্পের।
কুষ্টিয়ার তিলের খাজার নাম শোনেননি বা খাননি এমন মানুষ বাংলাদেশে পাওয়া দুষ্কর। দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবারের তালিকায় অনেক আগে থেকেই কুষ্টিয়ার তিলের খাজা স্থান করে নিয়েছে। জনপ্রিয়তার দিক দিয়েও দারুণভাবে এগিয়ে স্বল্পমূল্যের এ খাবারটি।
একটা সময় কুষ্টিয়া সদর ও কুমারখালী উপজেলায় এ পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল কয়েকশ পরিবার। হাতে তৈরি, খেতে দারুণ সুস্বাদু কুষ্টিয়ার এ তিলের খাজা রাজধানীসহ সারাদেশের রেলওয়ে স্টেশন, বাস স্টেশন ও লঞ্চঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হতে দেখা যায়।
এসব জায়গায় ক্রেতা আকৃষ্ট করতে খুব বেশি হাঁক-ডাকের প্রয়োজন না পড়ায়, বুঝে নিতে কষ্ট হয় না যে, এ খাজার ইতিহাস খুবই ‘সমৃদ্ধ’। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও কুষ্টিয়ার তিলের খাজার উপস্থিতি মেলে।
শত বছরের এ খাদ্যপণ্যটি এখন ক্ষুদ্রশিল্পে রূপ নিয়েছে। কুষ্টিয়ার মাটি ছাড়িয়ে এটি এখন অন্যান্য জেলায়ও তৈরি হচ্ছে। তবে ঠিক কবে থেকে এ তিলের খাজার উৎপাদন শুরু, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যায় না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের কুষ্টিয়া শহরে বেকারি পণ্যের জন্য পরিচিত দেশওয়ালী পাড়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বী পাল সম্প্রদায়ের মানুষ এ খাবার তৈরি করতেন। ১৯০০ সালের কাছাকাছি সময়ে ‘তেলি’ সম্প্রদায়ের লোকদের মাধ্যমে এ খাবারটি প্রথম কুষ্টিয়ায় তৈরি হয়।
কুষ্টিয়ার একটি খামারে কাজ করাতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ‘তেলি’ সম্প্রদায়ের কয়েকজনকে ভারতের অন্য অঞ্চল থেকে এখানে আনে। কৃষিপণ্য তিল থেকে তেল নিঃসরণের কাজটি করার দায়িত্ব পড়ে তাদের ওপর। সেই হিসেবে এ মিষ্টান্নের উদ্ভাবক সেই ‘তেলি সম্প্রদায়’।
মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলে, ওই তেলি সম্প্রদায়কে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে ওই এলাকায় কয়েকটি পরিবারকে তিলের খাজা তৈরি করতে দেখা যায়। ৭০-এর দশকে কুষ্টিয়া শহরের চর মিলপাড়ায় কয়েকটি খাজা তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। এরপর থেকেই কুষ্টিয়ায় ধীরে ধীরে তিলের খাজার প্রসার ঘটতে থাকে। ক্রমেই কুষ্টিয়ার তিলের খাজার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও।
সাধারণত কুষ্টিয়া জেলায় তিন ধরনের তিলের খাজা তৈরি হয়। তিলভেদে এই প্রকার নির্ণয় করা হয়। তিলের খাজা তৈরির প্রধান উপকরণ তিল ও চিনি।
চুলায় চাপানো বড় লোহার কড়াইয়ে চিনি ঢেলে জাল দিয়ে তৈরি করা হয় ‘সিরা’। নির্দিষ্ট সময় পর নামানো হয় চুলা থেকে। হালকা ঠান্ডা হলে চিনির সিরা জমাট বেঁধে যায়। তখন শিংয়ের মতো দোডালা গাছের সঙ্গে হাতে টানা হয় ওই জমাট বাধা চিনির সিরা। একপর্যায়ে বাদামি থেকে সাদা রঙে পরিণত হলে, কারিগররা বিশেষ কায়দায় হাতের ভাঁজে ভাঁজে টানতে থাকেন। তখন এর ভেতরে ফাঁপা আকৃতির সৃষ্টি হয়। সিরা টানা শেষ হলে রাখা হয় পরিষ্কার স্থানে। নির্দিষ্ট মাপে কেটে তাতে মেশানো হয় খোসা ছাড়ানো তিল। এভাবেই তৈরি হয় তিলের খাজা। পরে এগুলো প্যাকেটজাত করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে।
কারিগররা জানান, আরও এক ধরনের তিলের খাজা তারা তৈরি করেন। তাতে দুধের ছানা মেশানো হয়। এর উপকরণ ছানা, চিনি ও তিল। কারখানায় প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তিলের খাজা তৈরি হয়।
চিনি ও দুধ স্থানীয় বাজার থেকে কেনা হলেও তিল কেনা হয় চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর ও ফরিদপুর অঞ্চল থেকে। তবে ভালোমানের তিল পাহাড়ি অঞ্চল থেকেও সংগ্রহ করা হয়। সাধারণ তিলের খাজা ১৮০ ও স্পেশাল তিলের খাজা ৩৫০ টাকা কেজি এবং এক প্যাকেট ২০ টাকায় বিক্রি হয়।
তিলের খাজা তৈরির কারখানার মালিক সাধারণত সেখানকার শ্রমিকরাই। এটি পরিচালিত হয় অংশীদারী ব্যবসা হিসেবে। প্রতিটি কারখানায় মালিক-শ্রমিক মিলে ৩০-৫০ জন থাকেন। তারা যৌথভাবে বিনিয়োগ করেন। তবে এর বাইরে নিজস্ব মালিকানার কারাখানাও রয়েছে।
মালিক ও কারিগরদের অভিযোগ, কুষ্টিয়া ছাড়াও ঢাকা ও দেশের কয়েকটি জেলায় তিলের খাজা তৈরির কারখানা আছে। অন্য জেলায় তৈরি হলেও অনেকেই এটি কুষ্টিয়ার নাম দিয়ে বাজারে ছাড়েন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সারা বছরই তৈরি করা হয় তিলের খাজা। তবে শীত মৌসুমে এর আলাদা কদর রয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে বাড়তি লোকের কর্মসংস্থান। এসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সুবিধা সৃষ্টি করা হলে এ শিল্পকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
কিন্তু সে সুবিধা না থাকার কারণে সম্ভাবনা সত্ত্বেও প্রসার ঘটছে না এ ক্ষুদ্রশিল্পের। দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক অনটন আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে এ শিল্প।
বর্তমানে কুষ্টিয়ায় দুটি তিলের খাজা তৈরির কারখানা আছে। এর মধ্যে জয়নাবাদ এলাকায় একটি, অপরটি মিলপাড়ায়। জয়নাবাদে সবচেয়ে নামকরা ‘১নং নিউ স্পেশাল ভাই ভাই তিলের খাজা’ কারখানাটি অবস্থিত।
কথা হয় কারখানা মালিকের ছেলে আরিফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়টি আমরা জেনেছি। কিন্তু সম্ভাবনা থাকার পরও এ ক্ষুদ্রশিল্পের প্রসার ঘটছে না। আগে শতাধিক পরিবার এর সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন আমার কারখানায় কাজ করছেন মাত্র ২৬ জন শ্রমিক। সার্বিক সহায়তা পেলে এ শিল্পকে আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সম্ভব।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. এহেতেশাম রেজা বলেন, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়াটা আমাদের জন্য গৌরবের। এ পণ্যের বিকাশে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব। ক্ষুদ্র এ শিল্পটাকে এগিয়ে নিতে ও স্বাস্থ্যগত মান ঠিক রাখতে কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ঋণের ব্যবস্থাও করা হবে।
নয়াশতাব্দী/এনএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ