লালমনিরহাটে কৃষি অর্থনীতিতে সৌর সেচ পাম্প ব্যবহারে শস্য উৎপাদনে ব্যয় কমেছে এবং হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখে। এতে ডিজেল জাতীয় তেল আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে।
জেলা কৃষি দপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার ৫টি উপজেলায় ৫৩টি সৌর শক্তি চালিত সেচ পাম্প রয়েছে। এগুলো সমবায় সমিতির অধিনে কৃষকরাই পরিচালনা করে আসছে। সেচ নির্ভর জমিতে যেমন সেচের ব্যয় হ্রাস পেয়েছে, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা ডিজেল সাশ্রয় করছে। এই সেচ পাম্পের আওতায় এসেছে প্রায় ৩ হাজার একর বোরো ধানের জমি। সেচ পাম্পগুলোর আওতায় উৎপাদন হবে প্রায় ৮ হাজার ৫০ মে. টন খাদ্যশস্য।
এখন আর রাত জেগে বৈদ্যুতিক পাম্প বা শ্যালোইঞ্জিন চালিত পাম্পের উপর নির্ভর করতে হয় না। এতে কৃষি শ্রমিকের অরিতিক্ত মজুরি ও শ্রম ঘণ্টা কমেছে। বিদ্যুৎ বিল ও ডিজেল দিয়ে পানি সেচ ব্যবস্থায় জমিতে পানি কম-বেশি হওয়া নিয়ে বিবাদ দেখা দেয় গ্রামে। এখন সেচের পানি নিয়ে বিবাদ নেই বললেই চলে। সমবায় ভিত্তিতে কৃষক জমিতে বাই রোটেশনে পানির সেচ সুবিধা পেয়ে থাকে। জমিতে ঘুরে ঘুরে পাম্প ম্যানেজার সেচ দিয়ে থাকে। যত পানি লাগে তা প্রায় বিনা মূল্যে পাচ্ছে কৃষক। বিনামূল্যের সৌর চালিত সেচ পাম্প কৃষকের সেচ কাজে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
জেলায় এই সৌর সেচ পাম্প ব্যবহারের ফলে প্রতিবছর সেচ কাজে ব্যবহৃত বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা প্রায় ১৬ কোটি টাকার ডিজেল সাশ্রয় হচ্ছে বলে জানা যায়। এই পাম্প কৃষিতে এক নিরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। এটি পরিবেশ বান্ধব ও নবায়ন যোগ্য। এতে কোনো শব্দ দূষণ ও বায়ু দূষণ হয় না। সৌর চালিত পাম্পগুলোর দুইটি রয়েছে জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার গোতামারী বিলুপ্ত ছিটমহল ও জেলা সদরের কুলাঘাটের বাঁশপঁচাই বিলুপ্ত ছিটমহলে। অন্য গুলো রয়েছে বিএডিসির সেচ প্রকল্পের অধিনে ৫টি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
এসব সৌরশক্তি চালিত সেচ পাম্পের কোনো কোনটির পানি উত্তোলনের ক্ষমতা হাফ কিউসেক। আবার কোনটি এক কিউসেক। এক কিউসেক সৌরশক্তি চালিত পাম্প স্থাপনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৩ লাখ টাকা। হাফ কিউসেক সৌরশক্তি চালিত পাম্প বসাতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। সৌর চালিত ৫৩টি সেচ পাম্প প্রায় ৬৮০টি ডিজেল চালিত অগভীর নলকূপের (সেচ পাম্পের) সমান কাজ করে। শুস্কমৌসুমে প্রায় চার মাস পাম্পগুলো সেচের আওতায় সার্বক্ষনিক পানি উত্তোলন করে থাকে। ৫৩টি পাম্প হতে প্রায় ৭১৯.৬ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়।
প্রতিবছর এসব সৌরশক্তি চালিত পাম্প বাবদ কৃষকদের ৭ হাজার ৫০০ হতে ১০ হাজার টাকা রক্ষণাবেক্ষন বাবদ চার্জ দিতে হয়। এছাড়া অন্য কোনো খরচ নেই বললেই চলে। কৃষকদের সেচ পাম্প ভিত্তিক সমিতির মাধ্যমে সরকারি এই সৌরশক্তি চালিত পাম্পগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে। কৃষকদের সমিতির সভাপতি/সম্পাদক এবং অন্যান্য সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়ে আসছে। সমিতির অধিনে প্রতিটি সেচ পাম্প পরিচালনায় একজন দক্ষ কৃষি শ্রমিক দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে রেখেছে কৃষক সমিতিগুলো। মূলত তিনিই বাই রোটেশনে ও চাহিদার ওপর নির্ভর করে পর্যায়ক্রমে সৌর চালিত পাম্প দিয়ে সেচ দিতে থাকেন।
সেচ নালা ও পানি সরবরাহের দায়িত্বে কৃষক বা জমির মালিকের তেমন তদারকির প্রয়োজন হয় না। সমধিকার ভিত্তিতে সেচ চালু থাকে। পানি আগে পরে নেওয়া নিয়ে হুড়াহুড়ি করতে হয় না। ফলে কৃষককে পানি নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হয় না। এতে কোনো সংঘাতও সৃষ্টি হয় না।
কৃষক রমজান আলী (৫৫) জানান, এক কিউসেক শক্তি সম্পূর্ণ পাম্প দিয়ে প্রায় ৩০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়া যায়। অর্ধ কিউসেক দিয়ে প্রায় ১৫ হেক্টর কৃষি জমিতে সেচ সুবিধা দেয়া যায়। এতে করে শুষ্ক মৌসুমে বোরো জাতীয় ধানের জমি প্রায় ৩ হাজার একর জমি সেচের আওতায় আনা যায়। বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা আমদানিকৃত ডিজেল সাশ্রয় হয় প্রায় ৬ কোটি টাকা। শ্রমের ব্যয় কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। সৌর শক্তি চালিত সেচ পাম্পগুলো নবায়ন যোগ্য। এখানে যান্ত্রিক কোনো খরচ নেই। শুধুমাত্র সৌর প্যানেলগুলো মাঝে মাঝে সাবান-সোডা দিয়ে পরিস্কার করে দিতে হয়।
তিনি আরও জানান, সরকার প্রতিটি সেচ পাম্প থেকে বছরে ৭০৫০ টাকা হতে ১০০০০ টাকা আয় করছে। এতে সরকারের বাৎসরিক আয় হয় প্রায় ৬ লাখ ৬২ হাজার ৫০ টাকা। ২৫-৩০ বছর সেচ পাম্পগুলোতে বড় ধরণের কোনো সংস্কার কাজ করতে হবে না। সেচ মৌসুমের পরেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা যাবে। সেচ মৌসুমের পর অন্য সময় দিনের আলোতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দেওয়া যেতে পারে। এই ৮ মাস সৌর প্যানেলগুলো মাঠে পড়ে থাকে। কিছুদিন পর ডিজেল নির্ভর কোনো সেচ পাম্প দেশে থাকবে না।
নয়াশতাব্দী/টিএ/একে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ