মাত্র একজন শিক্ষক দিয়েই চলছে ৫০ শিক্ষার্থীর পাঠদান কার্যক্রম। শুধু তা-ই নয়, ওই একজনকেই করতে হয় স্কুলের পরিস্কার-পরিছন্নতা, পতাকা উত্তোলনসহ সকল দাপ্তরিক কাজ! এতে শিক্ষার গুণগতমান অর্জন তো দূরের কথা, নামমাত্র শিক্ষাও পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। ফলে শিক্ষা সংকটে পড়ছে বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা।
সম্প্রতি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ৫নং চর রুস্তম আলী মাস্টার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেখা গেছে এমনই ভয়াবহ চিত্র!
সরেজমিনে দেখা যায়, জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার নয়ানগর ইউনিয়নের ৫নং চর গ্রামে অবস্থিত বিদ্যালয়টি। বাইরে থেকে দেখতে ভবনটি খুব সুন্দর, চোখে পড়ার মতো। ভবনের শ্রেণি কক্ষগুলো নানা রকম ছবি দিয়ে সুন্দর করে সাজানো গোছানো। দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের নামে প্রতিটি কক্ষের নামকরণ। এই বিদ্যালয়ে সবই আছে, অভাব একটাই! আর তা হলো শিক্ষক সঙ্কট।
পাঁচটি পদের বিপরীতে আছেন মাত্র একজন শিক্ষক। তার নাম মো. শাহ জামাল। যিনি ৬ বছর ধরে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে সরকারিকরণ হওয়ার পর থেকে বিদ্যালয়টিতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে প্রধান শিক্ষক শাহ জামালের সঙ্গে ছিলেন আরেকজন সহকারী শিক্ষক। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ওই সহকারী শিক্ষক বদলি হয়ে চলে যান। এরপরে বিদ্যালয়ে আর কোনো সহকারী শিক্ষক আসেননি। ৪ জন সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে।
বিদ্যালয়ে খাতা কলমে ছয়টি শ্রেণিতে মোট শিক্ষার্থী রয়েছে ৭২ জন। তাদের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকে ১০ জন, প্রথম শ্রেণিতে ১০ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১২ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ১২ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ১৩ জন এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ১২ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন।
স্কুল ঝাড়ু দেওয়া, দরজা-জানালা খোলা, পতাকা ওড়ানোসহ সব দায়িত্ব একাই পালন করছেন প্রধান শিক্ষক শাহ জামাল। নেই কোনো পিয়ন। ফলে সব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চরম বিপাকে পড়ছেন তিনি।
এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক শাহ জামাল বলেন, ২০১৭ সাল থেকে বিদ্যালয়টি পাঠদান কার্যক্রম শুরু করে অন্য বিদ্যালয় থেকে ধার করা শিক্ষক দিয়ে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে আমি প্রধান শিক্ষক হিসেবে এই বিদ্যালয়ে যোগদান করি। আমরা দুজন শিক্ষক ২০২২ সাল পর্যন্ত মোটমুটি পাঠদান চালিয়ে যাই। ২০২৩ সালের শুরু থেকেই সেই সাময়িকভাবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক তার আগের স্কুলে চলে যান। এরপর থেকে এক বছরের বেশি সময় ধরে আমি একাই স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।
প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকায় প্রায়ই আমাকে দাপ্তরিক বিভিন্ন কাজে উপজেলা সদরে যেতে হয় জানিয়ে শাহ জামাল বলেন, শিক্ষক না থাকায় অভিভাবকেরা সন্তানদের এ বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে চান না। একসময় এই বিদ্যালয়ে প্রায় ২শ ছাত্রছাত্রী থাকলেও, শিক্ষক সংকটে কমতে কমতে এখন প্রায় ৫০-৬০ জনে গিয়ে ঠেকেছে। অনেক অভিভাবকই ছাড়পত্র নিয়ে যাচ্ছেন।
শিক্ষক সঙ্কটের কারণ জানিয়ে তিনি আরও বলেন, শিক্ষকরা এখানে আসতে চান না। এর মূল কারণ হচ্ছে বিদ্যালয়ে আসার রাস্তাঘাট খুবই খারাপ। এ বিদ্যালয়টি চর অঞ্চল এলাকায় অবস্থিত। বর্ষার সময় পায়ে হেঁটে দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে আসতে হয়। এসময় মোটরসাইকেল দিয়ে কোনোরকম আসা যায়। এছাড়া কোনো গাড়ি-ঘোড়াও চলে না। বর্তমানে রাস্তার দুই পাশেই ভুট্টাক্ষেত। রাস্তা দিয়ে একা আসাও ভীতিকর।
এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শরিফ, শাপলা, নিলুফাসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, শিক্ষক না থাকায় তাদের ক্লাস ঠিকমতো হয় না। নতুন শিক্ষক নেওয়া হলে তাদের লেখাপড়া আরও ভালো হতো।
স্থানীয়রা জানান, গত এক বছর ধরে প্রধান শিক্ষক শাহ জামাল ছাড়া বিদ্যালয়টিতে আর কোনো শিক্ষক নেই। তিনি একাই স্কুলের সব কাজ করেন। স্কুলটি চর এলাকায় অবস্থিত। স্কুলে আসার রাস্তাঘাট একদমই খারাপ। কাঁচা রাস্তা দেখে কোনো শিক্ষক এই স্কুলে আসতে চান না। বর্ষার সময় পায়ে হেঁটেও চলাচল করা যায় না।
বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ডা. আব্দুল মালেক বলেন, বিদ্যালয়টি চর অঞ্চলে হওয়ায় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার আগে শিক্ষকরা স্কুল দেখে আর আসতে চান না। কারণ স্কুলে আসার রাস্তাঘাট খুবই খারাপ। আমরা কয়েক দফায় উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছি।
আমি নতুন এসেছি জানিয়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী চকদার বলেন, আসার পরে বিষয়টি জেনেছি। দুই-একদিনের মধ্যেই ডেপুটেশনে আমরা ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষক দিয়ে দেবো।
জামালপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এমএম মিজানুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে আমি না জেনে কিছু বলতে পারবো না। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছ থেকে বিস্তারিত জানতে হবে।
নয়াশতাব্দী/টিএ/এনএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ