প্রায় ৮০ বছর আগে দেশের উত্তরাঞ্চলে অবাধ বিচরণ ছিল নীলগাইয়ের। ১৯৪০ সালের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে নীলগাইয়ের দেখা মিলত। বনাঞ্চল উজাড়, বসবাসের অনুপযোগী পরিবেশ, খাদ্য সংকট ও অবাধ শিকারের কারণে প্রাণীটি আশঙ্কাজনক হারে কমতে থাকে।
বাংলাদেশে বিলুপ্তির তালিকায় থাকা নীলগাই গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে রয়েছে মাত্র দুটি। এর মধ্যে একটি পুরুষ ও অন্যটি মাদি নীলগাই। এর বাইরে দেশে আর কোথাও নীলগাইয়ের সন্ধান মেলেনি।
গত ১ আগস্ট সাফারি পার্কে থাকা নীলগাই থেকে দুটি শাবক জন্ম হয়েছে। তবে নবজাতক দুটি মাদি না পুরুষ তা এখনো নির্ণয় করা যায়নি। আর নতুন জন্ম নেয়া শাবক দুটির আগমনে নতুন সম্ভাবনা দেখছেন পার্ক কর্তৃপক্ষ।
পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সহকারী বন সংরক্ষক তবিবুর রহমান জানান, ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা গ্রামের মামুদপুর-ঠুঠাপাড়া বর্ডার এলাকার বাসিন্দারা একটি নীলগাই ধরে জবাইয়ের প্রস্তুতি নেয়।
পরে বিজিবি-৫৩ (মামুদপুর বিওপি) সদস্যরা ওই মাদি নীলগাইকে উদ্ধার করে, রাজশাহীর বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগে হস্তান্তর করলে নীলগাইটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে আনা হয়।
অপরদিকে ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি নওগাঁর মান্দা উপজেলার জোতবাজার এলাকায় অপর একটি নীলগাই আটক করে জবাই করার প্রস্তুতি নেয়া হয়। পরে রাজশাহীর বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ স্থানীয় উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় জবাইয়ের প্রস্তুতির সময় একটি পুরুষ নীলগাই উদ্ধার করে। পরে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দিয়ে ২০১৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরের রামসাগর জাতীয় উদ্যানে স্থানান্তর করা হয়। পরে সেখান থেকে পুরুষ নীলগাইটি প্রজননের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে আনা হয়।
পার্কের ওয়াইল্ডলাইফ সুপারভাইজার মো. সারোয়ার হোসেন খান জানান, হেমন্ত থেকে শীতকালের শুরুর দিক পর্যন্ত সময়ে তুলনামূলক বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন পুরুষ নীলগাই সম্মতিসূচক লেজ নাড়াচাড়ার পর মাদি নীলগাইয়ের সঙ্গে মিলিত হয়।
প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পুরুষ নীলগাই একাধিক মাদি নীলগাইয়ের সঙ্গে মিলিত হয়ে থাকে। গর্ভধারণ কাল গড় ২৪৩ দিন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে যমজ বাচ্চা প্রসব করে, ক্ষেত্রবিশেষে ১টি থেকে ৩টি বাচ্চাও প্রসব করে থাকে। জন্মের ৪০ মিনিটের ভেতর দাঁড়াতে পারে। পুরুষ শাবক ৩ বছর এবং মাদি ২ বছরে প্রজননক্ষম হয়ে উঠলেও এদের গড় আয়ু ২১ বছর।
তিনি আরো জানান, পুরুষ নীলগাইয়ের বর্ণ গাঢ় ধূসর, অনেকটা কালচে রঙের। অনেক সময় নীলচে আভা দেখা যায় বলে এদের নীলগাই নামকরণ করা হয়েছে। শুধু পুরুষ নীলগাইয়ের দুটি কৌণিক, মসৃণ ও সামনের দিকে কিঞ্চিৎ বাঁকানো দুটি শিং আছে। পুরুষের উচ্চতা ৫২-৫৮ ইঞ্চি, শিংয়ের দৈর্ঘ্য ৮-১২ ইঞ্চি। মাদি নীলগাই এবং শাবকের রং লালচে বাদামি কিন্তু খুরের ওপরের লোম সাদা। ঠোঁট, থুতনি, কানের ভেতরের দিক ও লেজের নিচের তলদেশ সাদা। নীলগাই ছোট ছোট পাহাড় আর ঝোপ-জঙ্গলপূর্ণ মাঠে চড়ে বেড়াতে ভালোবাসে। ঘন বন এড়িয়ে চলে। সচরাচর ৪ থেকে ১০ সদস্যের দল নিয়েই নীলগাই ঘুরে বেড়ায়। দলে কখনও ২০ বা তার বেশি সদস্যও থাকতে পারে।
তিনি আরো জানান, নীলগাই গাছে ঢাকা উঁচু-নিচু সমতলে বা তৃণভূমিতে যেমন স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করতে পারে, তেমনি আবার শস্যক্ষেত্রে নেমে ক্ষতি করতে পটু। সকাল আর বিকেলে খাওয়ার পাট চুকিয়ে দিনের বাকি সময়টা গাছের ছায়ায় বসে কাটায়। মহুয়া গাছের রসালো ফুল এদের দারুণ পছন্দ। পানি ছাড়া এরা দীর্ঘসময় কাটিয়ে দেয়, এমনকি গরমের দিনেও এরা নিয়মিত পানি খায় না। আত্মরক্ষার প্রধান উপায় দৌড়ে পালানো। দ্রুতগামী ও শক্তিশালী ঘোড়ার পিঠে না চড়ে নীলগাই ধরা প্রায় অসম্ভব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক মো. জাহিদুল কবির বলেন, উদ্ধারকৃত স্ত্রী ও পুরুষ নীলগাইকে জবাইয়ের পূর্বমুহূর্তে উদ্ধার করা হয়। সেহেতু বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হওয়ার কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। প্রায় দীর্ঘ ৮০ বছর পর ভারত থেকে আসা নীলগাই বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর তাদের গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে আনা হয়। এরা জুটি বাঁধার ১১ মাস ১১ দিন পর গত পহেলা আগস্ট দুটি ফুটফুটে বাচ্চা জন্ম দেয়।
বর্তমানে সবাই সুস্থ আছে। বাংলাদেশ নীলগাইশূন্য হলেও ভারতে লাখের ওপর নীলগাই রয়েছে। সাফারি পার্কে সংরক্ষিত নীলগাই দুটি ভারত সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করার পর সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের কাছ জবাই করার পূর্বমুহূর্তে উদ্ধার করা হয়।
আর যদি ১০-২০ মিনিট দেরি হতো তাহলে মাংসের জন্য নীলগাই দুটি জবাই হয়ে যেত। বাংলাদেশের শেষ নীলগাইটিকে এভাবেই হত্যা করা হয়েছে এবং প্রায় ৮০ বছর আগেই আমরা প্রকৃতি থেকে নীলগাইয়ের সমাপ্তি টেনেছিলাম। আশি বছর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের দুটি নীলগাই বাচ্চা জন্ম দিয়েছে। আমরা আশা করছি বিলুপ্তির তালিকায় থাকা নীলগাই গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের মাধ্যমে আবারো প্রাকৃতিক পরিবেশে ফিরে আসবে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ