থামছে না মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) এবং রাখাইনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির ত্রিমুখী সংঘর্ষ। উল্টো বাড়ছে হামলা-পাল্টাহামলার ঘটনা। হেলিকপ্টার থেকে মিয়ানমার সেনাদের ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে বাংলাদেশি এক নারীসহ দুজন নিহত হয়েছেন। গতকাল সোমবার বেলা ২টার দিকে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বেতবুনিয়ার সীমান্তের জলপাইতলী গ্রামে ওই ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- একই গ্রামের বাদশা মিয়ার স্ত্রী হোসনে আরা (৪৫) ও উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নবী হোসেন (৬৫)। তিনি বালুখালী আশ্রয়শিবিরের ৮-ই ব্লকের বাসিন্দা ছিলেন।
এদিকে ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে চলমান সংঘর্ষের মধ্যে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছেন দেশটির চাকমা সমপ্রদায়ের প্রায় ৪০০ জন। পাশাপাশি কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাও সীমান্তে জড়ো হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে দেশের বিজিবি ও কোস্টগার্ড। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সীমান্তের আরও পাঁচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এছাড়া মিয়ানমার থেকে এরই মধ্যে ১০৬ সীমান্তরক্ষী পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। তাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে কয়েকজনকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান (ইউপি) এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, মিয়ানমারের মর্টার সেলের আঘাতে দুজনের মৃত্যুর হয়েছে। গতকাল বেলা পৌনে ৩টার দিকে রোহিঙ্গা ব্যক্তিকে দুপুরের খাবার দেয়ার জন্য রান্নাঘরে যান হোসনে আরা। তখন মর্টার শেলটি এসে রান্নাঘরের ওপর পড়ে।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মান্নান বলেন, দুই পক্ষের গোলাগুলির সময় মর্টার শেল এসে বিস্ফোরিত হয়েছে। তখন ঘটনাস্থলে দুজন নিহত হন। তবে হেলিকপ্টার থেকে বোমা মারার সময় গোলাটি এসে পড়েনি বলে মন্তব্য করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
সীমান্তের আশপাশের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত রোববার রাত থেকে সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর ঢেঁকিবনিয়া থেকে তীব্র গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে। সেখানে রাখাইন রাজ্যের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) বিজিপির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে হামলা চালালে এ লড়াই শুরু হয় বলে জানা গেছে।
লড়াইয়ে উভয় পক্ষ মর্টার শেল, রকেট লাঞ্চার, মেশিনগানসহ ভারী অস্ত্র ব্যবহার করছে। এর আগে গতকাল বিজিপির আরেকটি চৌকি তুমব্রু রাইট ক্যাম্প আরাকান আর্মি দখল করে বলে জানা গেছে। ওই চৌকি থেকে ঢেঁকিবনিয়ার দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার। নাইক্ষ্যংছড়ির কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও সংবাদকর্মী জানান, বিজিপির তুমব্রু রাইট ক্যাম্প এবং ঢেঁকিবনিয়া সীমান্ত চৌকি ছাড়া প্রায় ৪৮ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় বিজিপির সব চৌকি আরাকান আর্মি দখলে নিয়েছে।
তুমব্রু রাইট ক্যাম্প এবং ঢেঁকিবনিয়া সীমান্ত চৌকি দখলের জন্য আরাকান আর্মি চেষ্টা চালাচ্ছে। জান্তার বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে আরাকান আর্মির ওপর গোলাবর্ষণ করছে। গোলাগুলি আর গোলাবর্ষণের বিকট শব্দে এপারের সীমান্তবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ঘুমধুম ইউপির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. আনোয়ার বলেন, গত শনিবার রাত ৩টার দিকে প্রচুর গুলির আওয়াজ শোনা গেছে। বাইশফাঁড়ি এলাকার বাসিন্দা নুরুল কবীরের বাড়িতে একটি গোলা এসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটিতে আগুন ধরে যায়। ঘুমধুম পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইমতিয়াজ ভূঁইয়া জানান, গত শনিবার বিকালে গোলাগুলি শুরু হয় এবং শেষ হয় গতকাল ভোররাতে।
এদিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে চলমান সংঘর্ষের মধ্যে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছেন দেশটির চাকমা সমপ্রদায়ের প্রায় ৪০০ জন। পাশাপাশি কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাও সীমান্তে জড়ো হচ্ছেন।
তথ্যটি নিশ্চিত করে কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, মিয়ানমারে দেশটির সরকারের জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মির সংঘর্ষ চলছে। এতে মিয়ানমার সীমান্তে বসবাসকারীদের মধ্যে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। তাঁদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে আছে। এ অবস্থায় তাঁরা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছেন। সীমান্ত অতিক্রম করে মিয়ানমার থেকে কোনো রোহিঙ্গা অথবা অন্য কোনো সমপ্রদায়ের লোকজন যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারেন, সে জন্য সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।
এদিকে গতকাল সোমবার সকাল ১০টার পর থেকে মিয়ানমারের বাহিনী আরাকান আর্মির অবস্থান লক্ষ্য করে হেলিকপ্টার থেকে বোমা হামলা করছে। অন্যদিকে আরাকান আর্মির আক্রমণের মুখে এ পর্যন্ত ১০৩ জন মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী পুলিশ (বিজিপি) সদস্য বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) হেফাজতে আছেন।
৩৪ বিজিবির অধিনায়ক কর্নেল আবদুল্লাহ আল মাশরুকি বলেন, প্রতিবেশী দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অনেক সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে তাদের সংখ্যা আপাতত বলা সম্ভব নয়। তারা দফায় দফায় আসছেন। সীমান্ত সুরক্ষায় বিজিবি বদ্ধপরিকর। সংঘর্ষ মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চললেও আমরা আমাদের দেশের ও সীমান্তবর্তী লোকজনের নিরাপত্তার স্বার্থে টহল জোরদার করেছি। বিদ্রোহীদের তাড়া খেয়ে বাংলাদেশে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের ঢুকে পড়ার ঘটনা এটিই প্রথম।
বলা হচ্ছে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। বর্তমানে নেপিদোকেন্দ্রিক সামরিক শাসকের হাতে দেশের প্রায় ৪৩ শতাংশ অংশের নিয়ন্ত্রণ নেই। অনেক জায়গায় বিদ্রোহীরা আলাদা বেসামরিক প্রশাসন চালু করেছে।
রাখাইন রাজ্যের লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের কক্সবাজার আশ্রয়শিবিরে অবস্থান করছে। গত কয়েক দশকে বিভিন্ন সময় এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশ সরকার এসব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য কাজ করছে। এ অবস্থায় রাখাইনে ধারাবাহিক সংঘাতের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
রাখাইনের বিভিন্ন জায়গায় জান্তার অনুগত সেনা ও নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে আরাকান আর্মি। এরকম একটি বার্তা দেখা গেছে রাখাইনের কিয়াকফিউ টাউনশিপে। এসব বার্তায় লেখা, কাণ্ডজ্ঞান (কমনসেন্স) ব্যবহার করে আত্মসমর্পণ করুন এবং মানুষের আলিঙ্গনে আশ্রয়লাভ করুন। স্থানীয়রা জানান, কিয়াকফিউ-ইয়াঙ্গুন হাইওয়েতের পাশে একটি গ্রামে এ ধরনের বার্তা পাওয়া গেছে।
অন্যান্য এলাকায়ও তা দেখা গেছে। গত শনিবার সকালেই তা লাগানো হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে জান্তার বাহিনীকে যুদ্ধ অথবা আত্মসমর্পণের একটি বেছে নিতে বলা হচ্ছে। বার্তায় বলা হয়, আশপাশের আরাকান আর্মির সদস্যদের কাছে আত্মসমর্পণ করুন এবং জনগণের বিপ্লবের অংশ হোন। মানুষ আপনাদের ক্ষমা করতে প্রস্তুত। জান্তার অনুগত বাহিনীর সেনাদের উচিত হবে না, মিন অং হ্লাইয়ের (সামরিক জান্তাপ্রধান) লাভের জন্য মূল্যবান সময় নষ্ট করা। তাদের বরং মানুষের কাতারে আসা উচিত।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, আরাকান আর্মি রাখাইনের পালেতওয়া অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এ ছাড়া কিয়াকতাউ, ম্রাউক-ইউ, মিনবিয়া টাউনশিপে ব্যাপক লড়াই চলছে। কিয়াকফিউ জেলার রামরি টাউনশিপে জান্তার ঘাঁটির পতন হয়েছে এবং সেনারা আত্মসমর্পণ করেছে। ওই অঞ্চলগুলোর অনেক ঘাঁটি থেকে জান্তার সেনারা সরে পড়েছে। কিছু ঘাঁটিতে এখনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি জান্তা।
আরাকান আর্মি দাবি করেছে, তারা এখন পর্যন্ত জান্তার পাঁচটি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর দখল করেছে। এগুলো হচ্ছে ৫৩৯তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন, ৩৭৭তম আর্টিলারি ব্যাটালিয়ন, ৩৭৪তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন, ৫৪০তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন এবং ৩৮০তম ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন।
এ ছাড়া ৩৭৫তম ও ৩৭৬তম ব্যাটালিয়নের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পথে রয়েছে আরাকান আর্মি। কিয়াকতাউয়ের এমওসি-৯ ঘাঁটিটিও হারানোর পথে জান্তা। পালংখালি ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল গফুর বলেন, রোববার রাত থেকেই পালংখালীর সীমান্তঘেঁষে মিয়ানমারে সংঘর্ষ চলছে। কিছুক্ষণ পরপরই ভারী বোমা, মর্টার শেলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হচ্ছে ঢেঁকুবনিয়ার বিজিপির সীমান্ত চৌকি থেকে।
ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, রোববারের সংঘর্ষ তুমব্রুতে চলেছিল সোমবার বেতবুনিয়ার রাইট ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায়। এদের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা। ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আবদুল্লাহ আল মাশরুকি বলেন, আমাদের সীমান্ত সুরক্ষিত।
বিজিবি সর্বোচ্চ সর্তক অবস্থায় রয়েছে। এপর্যন্ত ৯৫ জন বিজিপি সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মধ্যে ১৫ জন আহত। এদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
নাইক্ষ্যংছড়ির পাঁচটি বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা : বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় চলমান অস্থিরতার কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিবেচনায় বান্দরবান পার্বত্য জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করা হয়েছে। পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকবে।
গতকাল সোমবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আক্তারুন্নাহার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। স্কুলগুলো হলো- বাইশারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিমকুল তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
স্থানীয় পরিস্থিতির উন্নতি হলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, বান্দরবান পার্বত্য জেলা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনাক্রমে বর্ণিত বিদ্যালয়গুলোতে পুনরায় পাঠদান করাসহ বিদ্যালয় খোলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানা গেছে।
পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীর সংখ্যা বেড়ে ১০৬ : মিয়ানমারে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের যুদ্ধের মধ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা সশস্ত্র বিজিপি সদস্যের সংখ্যা শতাধিক পৌঁছেছে। কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার ভেতরে রোববার রাতেও ব্যাপক গোলাগুলি হয়েছে। আতঙ্কে সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের রাত কেটেছে নির্ঘুম।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম সোমবার সকালে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, তখন পর্যন্ত মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ১০৬ জন সদস্য অস্ত্রসহ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাদের নিরস্ত্র করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়েছে।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির যুদ্ধ চলছে গত কয়েক দিন ধরেই। শনিবার রাতে বিদ্রোহীরা বিজিপির একটি ফাঁড়ি দখল করে নিলে রোববার সকালে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ১৪ সদস্য।
বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই সংখ্যা বাড়তে থাকে। রোববার মধ্যরাতে বিজিবির পক্ষ থেকে মোট ৬৮ জন বিজিপি সদস্যের অনুপ্রবেশের কথা জানানো হয়েছিল। গতকাল সোমবার সকালে সেই সংখ্যা ১০৬ জনে পৌঁছেছে। বিজিবি জানিয়েছে, বাংলাদেশে আসা মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে অন্তত ২২ জন এসেছেন আহত অবস্থায়। তাদের মধ্যে সাতজনকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
গুলিবিদ্ধ সাত সীমান্তরক্ষী কক্সবাজার হাসপাতালে: মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) গুলিবিদ্ধ সাত সদস্যকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রোববার রাত সাড়ে ৯টা থেকে সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য সদর হাসপাতালে ভর্তি করে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)। তারা হলেন- জা নি মং, নিম লাইন কিং, ক্যে থিন সিন, ইয়ো ফো, মং র, মুলিউন থং, কিন মং জ। কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) আশিকুর রহমান বলেন, গুলিবিদ্ধ বিজিপির সাত সদস্য আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
তবে পুলিশ তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কায়সার হামিদ কেবল বলেছেন, তিনি ‘খোঁজখবর’ নিচ্ছেন।
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়েন পরিষদ চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, রোববার সন্ধ্যার পর থেকে রাত ২টা পর্যন্ত ধামনখালী সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের ঢেঁকিবুনিয়া এলাকায় ব্যাপক গোলাগুলি ও বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। তবে সকাল থেকে গোলগুলির আর কোনো শব্দ শোনা যায়নি।
তিনি বলেন, ‘এখানে আমাদের এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্ক রাতে ঘুমাতে পারেননি। সকালে এখন নতুন করে গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছি না। কিন্তু মানুষের আতঙ্ক কাটছে না।’
পালংখালীর ওপারের পরিস্থিতি আপাতত শান্ত থাকলেও বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তের ওপারে সোমবার সকালেও গুলির শব্দ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ঘুমধুম ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. শফিকুল ইসলাম।
থমথমে পরিস্থিতিতে তুমব্রু সড়কসহ আশপাশের সড়কগুলোতে যানবাহন চলাচল একপ্রকার বন্ধই রয়েছে রোববার থেকে। সীমান্ত এলাকায় পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদরাসা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কেউ বাড়ি থেকেও বের হচ্ছেন না। সীমান্ত এলাকার কয়েকটি বাজারে দোকানপাট প্রায় বন্ধ দেখা গেছে। এর মধ্যেও যারা বাজারে আসছেন তারাও দ্রুত বাড়ি ফিরছেন।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক শাহীন মুহাম্মদ ইমরান বলেন, সীমান্তে বিজিবিকে সর্বোচ্চ অবস্থান নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া যেখানে বসবাস ঝুঁকিপূর্ণ সে সব এলাকার লোকজনকে সরিয়ে নিতে উপজেলা প্রশাসনকে বলা হয়েছে। ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে মিয়ানমারের ক্ষমতা নেয় দেশটির সেনাবাহিনী।
২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষ দিক থেকে মিয়ানমারের তিনটি জাতিগত বিদ্রোহী বাহিনী একজোট হয়ে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ শুরু করে। বাহিনীগুলো হলো- তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি-টিএনএলএ, আরাকান আর্মি-এএ এবং মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি-এমএনডিএএ। তারা শান, রাখাইন, চীন ও কেয়াহ রাজ্যে লড়াই চালাচ্ছে।
বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও সেনাপোস্ট দখল করে ইতোমধ্যে তারা সাফল্য দেখিয়েছে। আরাকান আর্মি (এএ) এ জোটের অন্যতম অংশ। মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনের সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর একটি সশস্ত্র বাহিনী এটি। তারা রাখাইনের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াই করছে। রাখাইনে সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে লড়াইয়ের প্রভাব পড়ছে সীমান্তের এপারের জনগোষ্ঠীর মধ্যেও। যুদ্ধ শুরুর পর রোববার সবচেয়ে বড় অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটল।
২০২২ সালের আগস্টের শেষ ও সেপ্টেম্বরের শুরুতে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থেকে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। অনেক মানুষ আতঙ্কে সীমান্ত ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এর প্রতিবাদ, নিন্দা ও উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল ঢাকা।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ