ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মাদকের টাকায় ‘হকার’ এখন বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি!

প্রকাশনার সময়: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৮:৪১ | আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৯:১৭

কক্সবাজার সদর উপজেলার খরুলিয়া নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মুসলিম উদ্দিন (২৬) পেশায় একজন পলিথিন হকার। তবে মিয়ানমার থেকে মাদক ইয়াবা ও আইস এনে সারাদেশে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করে, মাত্র পাঁচ বছরেই তিনি এখন ২০ কোটি টাকার মালিক।

শুধু তা-ই নয়, কিনেছেন পুরো এলাকার অর্ধেক জমি। গ্রামের বাড়িতে গড়ে তুলেছেন অট্টালিকাও! কয়েকজন রোহিঙ্গা যুবক, বড় ভাই, স্ত্রী-শাশুড়ি, শালা, বোন ও বোনজামাইকে নিয়ে এলাকায় গড়ে তোলেন মাদকের বিশাল সাম্রাজ্য।

এলাকাবাসী জানান, জমি বিক্রির খবর কানে আসা মাত্রই কেনার জন্য ছুটে যান মুসলিম ও তার স্ত্রী তানিয়া। অথচ কয়েক বছর আগেও বৈধ আয়ের উৎস হিসেবে মাছ বাজারে ফেরি করে পলিথিন বিক্রি করতেন এই যুবক।

এতো অল্প সময়ে জেলার প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ীদেরও পেছনে ফেলে, মাদকের টাকায় এলাকার নতুন জমিদারে পরিণত হয়েছেন মুসলিম। নিজের মাদক কারবার আড়াল করতে দুই বছর ধরে খুলে বসেছেন কয়েকটি পোল্ট্রি ফার্মও।

আর এই সাইনবোর্ডে তাদের ‘একমাত্র আয়ের পথ পোল্ট্রি ফার্ম’ বলে প্রচারণা চালিয়ে গোপনে করছেন কোটি কোটি টাকার অবৈধ মাদক কারবার। এ কারবারের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ দিয়ে গড়ে তুলেছেন তিন তিনটি বাড়ি, খামার ও একাধিক ফার্ম।

সেইসঙ্গে মুসলিম তার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের নামে কিনেছেন এলাকার অর্ধেক জমি-জমা। বিভিন্ন ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা ও ব্যাংকের লকারে রয়েছে কেজি কেজি স্বর্ণ।

স্থানীয় লোকজন জানান, মাদক ব্যবসার আগে মুসলিম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাজারে পলিথিন বিক্রি ও তার ভাই সাদ্দাম রাজমিস্ত্রীর হেলপার হিসেবে কাজ করতেন। বাবা মমতাজ আহম্মদ ছিলেন ছিঁচকে চোর। অভাবের সংসারে পড়া-লেখা করতে পারেনি কেউই। ছোটবেলা থেকেই হকারি করে জীবিকা নির্বাহ করা মুসলিম, হঠাৎ বড়লোক হওয়ায় বিয়ে করেন স্থানীয় পকেটমার আলমের মেয়ে মাদক সম্রাজ্ঞী হিসেবে পরিচিত তানিয়াকে।

এর আগে থেকে তানিয়ার ভাই এরশাদ উল্লাহ, মা আনোয়ারা বেগমের পারিবারিকভাবেই ছিলো মাদক কারবার। ছাত্র জীবনে তানিয়া পরিবারের মাদক কারবারের হাল ধরেন এবং মাদকের চালান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাচার করতেন।

মুসলিম এরপর হকারি পেশা ছেড়ে স্ত্রী তানিয়া ও শালা এরশাদের মাধ্যমে মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ২৬ বছর বয়সী এই যুবককে। বর্তমানে তিনি মাদকের একটি বিশাল বাহিনী গড়ে তুলেছেন। এই বাহিনীর অধীনে রয়েছে ১৫ জন সদস্য, একাধিক মোটরসাইকেল ও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র।

তাছাড়া মাদক পাচারের জন্য স্ত্রী তানিয়াসহ বেশ কয়েকজন নারীকেও ব্যবহার করেন মুসলিম। কারাবারে টিকে থাকতে নিজের এলাকা ও জেলা শহরে গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটকে টিকিয়ে রাখতে নিজের এলাকা এবং বিভিন্ন জেলার আন্ডারওয়ার্ল্ড খ্যাত কতিপয় প্রভাবশালীদেরকে প্রতিদিন মাদকের ‘সৌজন্য’ কপি সরবরাহ করেন মুসলিম-তানিয়া দম্পতি। এখন এই দম্পতির হাতেই ওই এলাকার মাদকের একক নিয়ন্ত্রণ।

তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের জিরো টলারেন্স ঘোষণার পর, র‍্যাবের অভিযান ও বন্দুকযুদ্ধ শুরু হলে সৌদি আরবে পালিয়ে যান মুসলিম। পরে বন্দুকযুদ্ধ থমকে গেলে বীরদর্পে ফিরে এসে মাদক কারবারে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি।

স্থানীয় সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঝিলংজার ৮নং ওয়ার্ডের নয়াপাড়া গ্রামে স্থানীয় জাফর আলমের স্ত্রী খুন্নু আরা বেগমের কাছ থেকে ১০ গন্ডা জমি ক্রয় করে নির্মাণ করেছেন দুই তলা ভবন। তার পাশে স্থানীয় জিন্নাত আলীর কাছ থেকে ১০ গন্ডা জমি ক্রয় করে সেখানেও দোতলা ভবনসহ বানিয়েছেন আলিশান বাড়ি। স্থানীয় জাফর আলমের বাড়ি লাগোয়া মহেশখালীর এক ব্যক্তির কাছ থেকে ক্রয় করেছেন ৫ গন্ডা জমি। সেখানেও নির্মাণ করেছে ভবন। নিচে ভাড়া দিতে প্রস্তুত করেছেন দোকান। তার বাপ-দাদার পুরাতন ভাঙা বাড়িটিও পরিণত করেছেন সেমিপাকায়। বাড়ির পাশেই প্রায় দেড় বিঘার একটি বিশাল জমি নিয়েছেন লিজে। তার বাড়ির সঙ্গে আমান উল্লাহর দোকানের পশ্চিম পাশে স্থানীয় বিলকিস আরা ও শামশুল আলমের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকায় কিনেছেন ১৫ গন্ডা জমি।

এছাড়াও স্থানীয় বশির আহম্মদের বাড়ির সামনে পাকা রাস্তার ধারেই দক্ষিণ মিঠাছড়ির সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের কাছ থেকে ক্রয় করেছেন সোয়া ২০ গন্ডা জমি। স্থানীয় আব্দু শুক্কুরের বাড়ির দক্ষিণ পাশে মকবুল আহমদ, মোস্তাক আহমদ, মোজাম্মেল ও নুরুল হুদার কাছ থেকে কিনেছেন প্রায় এক একর জমি।

গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে স্থানীয় ছৈয়দ নুরের বাড়ির উত্তর পাশে জাফর আলমের কাছ থেকে ৪৫ লাখ টাকায় কিনেছেন ২৫ গন্ডা জমি। তার পাশে সম্প্রতি কিনেছেন আরও ৮ গন্ডা জমি।

এছাড়াও কয়েকটি দামি ব্র্যান্ডের বাইক আছে তার সংগ্রহে। নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে তার। এমনকি মুসলিমের কারণে পুরো এলাকার জায়গা-জমির দাম বেড়েছে কয়েকগুণ।

নয়াপাড়া গ্রামের বসিন্দারা জানায়, মুসলিম দুদকের হাত থেকে বাঁচতে বেশিরভাগ সম্পদ স্ত্রী, মা-বাবা, ভাই-বোন ও নিকটাত্মীয়দের নামে দিয়ে রেখেছেন। আত্মীয়-স্বজনের অনেকের নামেই করে রেখেছেন ব্যাংক ব্যালেন্স। অসম সম্পদের হিসাব সহজ করতে দুই বছর ধরে পোল্ট্রি ফার্ম ব্যবসা শুরু করে সেগুলোর লাইসেন্সও করেছেন।

এখানেই শেষ নয়, নিজেকে ঋণগ্রস্ত দেখাতে ব্যাংক থেকে নিয়েছেন অর্ধ কোটি টাকা ঋণ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালের ১৫ ডিমেম্বর রাতে শহরের কলাতলী থেকে মুসলিমের বড় ভাই সাদ্দামকে ১০ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে র‍্যাব। ওই মাদকের চালানটি মুসলিমের বলে স্বীকারোক্তি দেন সাদ্দাম। সেমসয় মুসলিমকে ওই মামলার ২নং আসামি করে সাদ্দামকে কারাগারে পাঠায় র‍্যাব।

এছাড়া গেল বছরের ১৯ জুলাই দুপুরে মুসলিমের একটি ইয়াবার চালান পাচার করতে গিয়ে র‍্যাবের হাতে গ্রেফতার হন তার বোন কহিনুর আক্তার। সেসময় কহিনুরের কাছ থেকে ১৮ হাজার ইয়াবা জব্দ করে র‍্যাব। ওই মামলায় তিনি এখনো কারাগারে।

এর আগে, ২০২১ সালের ১৪ ডিমেম্বর মুসলিমের একটি মাদকের চালান পাচার করতে গিয়ে কহিনুরের স্বামী নুরুল আলম ওরফে নুরু রামুর কলঘর বাজার থেকে এক কেজি আইসসহ গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘদিন কারাভোগের পর বর্তমানে জামিনে।

গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে মুসলিমের পোল্টি ফার্মে অভিযান চালায় র‍্যাব। অভিযানকালে অন্যরা পালিয়ে গেলেও ১০ হাজার ইয়াবাসহ ছৈয়দ হোসেন নামের এক রোহিঙ্গা যুবককে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় র‍্যাব। ওই মামলায় কর্মচারী রোহিঙ্গা ছৈয়দ দীর্ঘদিন কারাভোগের পর বতমানে তার ফার্মে কাজ করার পাশাপাশি নির্বিঘ্নে মাদক পাচার কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।

বছর কয়েক আগে মুসলিমের স্ত্রী তানিয়া ও শাশুড়ি আনোয়ারা বেগম ইয়াবাসহ গ্রেফতার হন। এছাড়া তার মাদক পাচারকারি সদস্যদের বিরুদ্ধে ঢাকার রমনা, উখিয়া, চকরিয়া-পেকুয়া, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, কক্সবাজার সদর, রামুসহ দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা রয়েছে।

একাধিক সূত্রের দাবি, বর্তমানে তার মাদক পাচার করতে গিয়ে সমাজের দারিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের অন্তত ১০ থেকে ১২ জন কারাভোগ করছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, নগদ অর্থ মুসলিম নিজের কাছে রাখেন না। ব্যবসার টাকার হিসাব থাকে তার স্ত্রীর অধীনে। মুসলিমের মাদক কারবারের টাকার আদান-প্রদান হয় কয়েকটি বিকাশের এজেন্ট ও একাধিক নম্বরের মাধ্যমে। প্রশাসনিক হয়রানি কিংবা গ্রেফতার এড়াতে মোটা অংকের টাকা নিজ হেফাজতেই রাখেন মুসলিম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সাধারণ মানুষের চোখে ধুলো দিতে এখন হয়েছেন পোল্ট্রি ফার্ম ব্যবসায়ী।

তারা আরও জানান, মিয়ানমার থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করে রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে তার বাড়িতে মজুদ করেন। পরে স্ত্রী তানিয়া মাদক ব্যবসায়ীদের দিয়ে তা বিক্রি করান। একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ঢাকা-বগুড়াসহ দেশের বিভিন্নস্থানে মাদক পাচার করে আসছেন এই দম্পতি।

তাদের দাবি, মেজর সিনহা হত্যার পর বন্দুকযুদ্ধ বন্ধ হওয়ায়, তিনি স্বাচ্ছন্দে ও ঝামেলামুক্তভাবেই মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন।

মাদক কারবারে এতটা সফল হতে আর কাউকে দেখেনি মন্তব্য করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, মুসলিম বাজারে হকারি করে পলিথিন বিক্রি করেছেন। মাদক কারবারে হঠাৎ তার এমন সফলতা দেখে বিস্মিত হয়েছি। তাকে দেখে মাদক কারবারে উঠতি বয়সের যুবকরাও মনযোগী হচ্ছে।

দীর্ঘদিন ধরে মাদক কারবারের কারণে ওই এলাকায় তার মাদকের বড় নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে উল্লেখ করে একাধিক সূত্র জানায়, মুসলিম নয়াপাড়ায় বসবাস করলেও তার মাদকের বড় বড় চালান যায় ঢাকায়। মিয়ানমার থেকে এসে সরাসরি তার মাদকের চালান যায় পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া, দয়াগঞ্জ, মীর হাজিরবাগ ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে।

তারেক, খাইরুল ইসলাম, নাজিম উদ্দিন, জাহাঙ্গীর ও মামুনসহ এলাকার একাধিক যুবক বলেন, মুসলিম এলাকার মাদক সম্রাট। মাদকের টাকার গরমে এলাকার অর্ধেক জমি তিনি নিজেই কিনে ফেলেছেন। তার কারণে ৫ লাখ টাকার জমির দাম বর্তমানে ২০ লাখে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

তাদের দাবি, কোমরে পিস্তল নিয়ে চলাফেরা করেন তিনি। বিরোধপূর্ণ জায়গা-জমি সব তার দখলে চলে গেছে। মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে এলাকার কোনো সাধারণ মানুষ কথা বলার সাহস পায় না। এভাবেই তিনি এলাকার নতুন জমিদারে পরিণত।

কয়েক বছরে এত সম্পদ অর্জন করা কিভাবে সম্ভব- জানতে চাইলে মুসলিম কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে তিনি নিজেকে পোল্ট্রি ফার্ম ব্যবসায়ী বলে দাবি করেছেন। পরে নিউজ না করতে নানা তদবির শুরু করেন এই মাদক কারবারি।

দুদকের কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, তার এইসব সম্পদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া হবে। অবৈধ সম্পদের সত্যতা পেলে মামলা করবে দুদক।

নয়াশতাব্দী/টিএ/এনএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ