ঢাকা, শনিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ১ রবিউস সানি ১৪৪৬

সীমান্তে আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা

প্রকাশনার সময়: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:৪৩

মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলির ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সংশ্লিষ্ট সীমান্তে। ওপার থেকে ছোড়া গুলিতে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অন্তত অর্ধশত সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার খবর পাওয়া গেছে। সীমান্তের ওপার থেকে আসছে টানা বিস্ফোরণের শব্দ। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বান্দরবান সীমান্তের ৬টি স্কুল।

পাশাপাশি সীমান্তজুড়ে নেয়া হয়েছে বাড়তি সতর্কতা। নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সতর্ক রয়েছে কোস্টগার্ড ও বিজিবি। জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে আসা গুলিতে প্রবীর চন্দ্র ধর (৫৯) নামে এক বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি তুমব্রু সীমান্তে এ ঘটনা ঘটে। এর আগে ভোরে তুমব্রু কোনার পাড়ায় একটি বসতঘরে মর্টারশেল এসে পড়ে। এসব ঘটনায় সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে গেছে।

এমন পরিস্থিতিতে গতকাল মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) অন্তত ৩৯ সদস্য সীমান্ত অতিক্রম করে তুমব্রুর বিজিবি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে।

বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন জানিয়েছেন, সীমান্তের গোলাগুলির ঘটনায় ঘুমধুম সীমান্তে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে পরিস্থিতি অনুকূলে আছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সংযুক্ত মহাসড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

সীমান্তের লোকজনকে সতর্ক ও নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। সীমান্তে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবি, পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সবাই সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কিছু সদস্যের পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার কথা শোনা যাচ্ছে বলেও জানান বান্দরবানের জেলা প্রশাসক।

বিজিবির কক্সবাজারস্থ ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল আশরোকি মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কয়েকজন সদস্য পালিয়ে আসার কথা জানালেও এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাদের সংখ্যা নিশ্চিত করতে পারেননি। তিনি বলেন, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সঙ্গে রাত থেকে তুমুল যুদ্ধের মধ্যে কয়েকজন বিজিপি সদস্য প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ সীমান্তে অনুপ্রবেশ করেছে।

এদের বিজিবির ঘুমধুম সীমান্ত বিওপিতে রাখা হয়েছে। বিজিপি সদস্যদের অস্ত্র ও গুলি বিজিবির কাছে জমা রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে ঘুমধুম সীমান্তে বিজিবির পক্ষে প্রেস বিফ্রিং করার কথা থাকলেও এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত প্রেস বিফ্রিং করা হয়নি।

স্থানীয়রা জানান, গত কয়েক দিন ধরে মিয়ানমারের ভেতরে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনীর সংঘাত চলছে। এতে ব্যবহার করা হচ্ছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক। এসব গোলাবারুদ আর বিস্ফোরকের বিকট শব্দে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের সীমান্ত এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।

ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ভোর থেকে মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরে ব্যাপক গোলাগুলি হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলিতে বাংলাদেশের একজন আহত হয়েছেন। এর আগে ভোরে মর্টারশেল এসে একটি বসতঘরে পড়ে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে দেশটির জান্তা বাহিনীর ৫০ সদস্য আশ্রয় নিয়েছেন তুমব্রু বিজিবি ক্যাম্পে।

সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ আতঙ্কে আছেন। আমরা সবাইকে বলেছি কোনো কাজ ছাড়া ঘর থেকে বের না হতে। এ অবস্থায় স্থানীয়দের সরানো হবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। আমি কিছু বলতে পারব না। এদিকে সীমান্তে এমন গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে অনেকে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন।

তুমব্রুর উত্তরপাড়ার স্থানীয় বাসিন্দা খায়রুল আমিন বলেন, যেভাবে মিয়ানমার থেকে গুলি এ পারে এসে পড়ছে তাতে পরিবার ও নিজেকে নিরাপদ মনে করছি না। আপাতত উখিয়ায় বোনের বাসায় আশ্রয় নিচ্ছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফিরব। খালেক নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, গতকাল সিএনজিচালিত অটোরিকশায় এসে শেল পড়েছে। আজ (গতকাল) এক কৃষকের শরীরে। ভোরে বসতঘরে। এমন পরিস্থিতিতে কেউ নিরাপদ নয়। তাই অন্য জায়গায় যাচ্ছি।

সীমান্তের পরিস্থিতি এখনো থমথমে। আমরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছি। ঘুমধুম ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. আলম বলেন, আমার ওয়ার্ডের কিছু মানুষ পার্শ্ববর্তী এলাকায় আশ্রয় নিচ্ছেন। ভোর থেকে ভারী অস্ত্রের বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঘুমধুম পুলিশ ফাঁড়ি তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক মাহাফুজ ইমতিয়াজ ভুঁইয়া বলেন, এখানকার পরিস্থিতি এ মুহূর্তে কিছুটা স্বাভাবিক আছে। সীমান্ত এলাকায় কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। বিজিবি ও আমরা তৎপর আছি। আতঙ্কিত হয়ে এলাকা ছাড়ার খবর তেমন নেই।

তবে ওপারের গোলাগুলির শব্দে এপারে ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিরাজ করছে উৎকণ্ঠা। তবে যোগাযোগ করা কষ্টসাধ্য হওয়ায় অনেকের পক্ষে রাখাইনে তাদের স্বজনের সর্বশেষ অবস্থা জানা সম্ভব হচ্ছে না। স্থানীয় রোহিঙ্গা বাসিন্দা মো. বাছের জানান, জান্তা সেনারা মিয়ানমারে তাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। অনেকে মারা গেছেন। কেউ কেউ আহত হয়েছেন। দিনে ভয়ে কেউ বাড়ি থাকার সাহস করছেন না। পাহাড়ে লুকিয়ে থাকছেন।

সুবিধাজনক সময়ে বাড়ি গিয়ে সামান্য খাবার-কাপড় নিয়ে আবার পাহাড়ে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। তিনি আরও জানান, এক সময় অবৈধ সিম ব্যবহার করে তাদের কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের খোঁজ নিতেন। এখন সিম ব্যবহার করা একেবারে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। অন্য দেশের সিম ধরা পড়লে বড় অঙ্কের জরিমানা করা হচ্ছে।

কক্সবাজার ও টেকনাফের আরও কয়েকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সীমান্তের ওপারে বসবাস করা স্বজনরা উদ্বিগ্ন। গতকাল রোববারও বান্দরবানের তুমব্রু ও টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্তের মিয়ানমার অংশে থেমে থেমে ভারী গোলাগুলির শব্দ পাওয়া গেছে। তবে এ দেশে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। স্থানীয়রা জানান, টেকনাফ সীমান্তের অপর পাশে মিয়ানমারে চলছে মর্টারশেল ও ভারী অস্ত্রের গোলাগুলির শব্দ।

গতকাল বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়ায় একটি গোলা এসে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দা সানজিদা বেগম বলেন, ‘সকাল সাড়ে ১০টা থেকে মিয়ানমারে মর্টারশেল ও ভারী গুলির শব্দে কান ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা। ভয় ও আতঙ্কে নিরাপদে সরে এসেছি। হঠাৎ দেখি, ভারী একটি গুলি আমার জামাতার ঘরে টিনের দরজা ছিদ্র হয়ে ঢুকে পড়েছে।

পরে বিজিবির সদস্যরা খবর পেয়ে এসে গুলিটি নিয়ে যায়।’ স্থানীয় আরেক বাসিন্দা মো. সোলেমান বলেন, ‘মিয়ানমারে গোলাগুলির শব্দে ঘরে থাকতে পারছি না। এক সপ্তাহ ধরে সীমান্তের ওপারে মর্টারশেল ও গুলির শব্দে আমরা অনিরাপদ বোধ করছি। ছেলেমেয়ে নিয়ে সব সময় ভয়ের মধ্যেই থাকতে হচ্ছে।’ স্থানীয় ইউপি সদস্য সিরাজুল মোস্তফা লালু বলেন, ‘টেকনাফের হোয়াইক্যং, তুলাতুলি ও কানজরপাড়া সীমান্তসংলগ্ন মিয়ানমার অংশে গোলাগুলি চলে। ভয়ে আমরা বাড়িঘরে থাকতে পারছি না। কাজে যেতেও ভয় পাচ্ছি।’

নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শফিকুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন পর তুমব্রু সীমান্তসংলগ্ন মিয়ানমারে ভারী গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশ সীমান্তে বসবাসকারীরা ভয়ভীতির মধ্যে রয়েছে। গুলি ছোড়ার শব্দ শোনার পর জনসাধারণের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

তবে সীমান্তের খুব কাছাকাছি বসবাসকারী লোকজনকে আতঙ্কিত না হতে অনুরোধ করা হচ্ছে। হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর আহমেদ আনোয়ারী বলেন, ‘মিয়ানমার সীমান্তে মর্টারশেলের মতো বিকট গোলাগুলির বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে রেখেছি।’ টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘সীমান্তের ওপারে যুদ্ধ চলছে। বিজিবি সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে, যাতে নতুন করে কোনো অনুপ্রবেশ না ঘটে।’

ছয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা: বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তের শূন্য রেখায় গোলাগুলির ঘটনায় ছয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা রয়েছে। উপজেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ত্রিরতন চাকমা জানান, গতরাত থেকে সকাল পর্যন্ত মিয়ানমারের ভেতরে গোলাগুলির কারণে ঘুমধুম সীমান্ত এলাকার বাইশ পারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজা বনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিমকূল তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রোববার একদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

সীমান্ত এলাকার শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নিরাপদে অবস্থান করার জন্য বলা হয়েছে বলেও জানান তিনি। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. ফরিদুল আলম হোসাইনি জানান, সীমান্তের একশ গজ দূরত্বে থাকা মিসকাতুন নবী দাখিল মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ