সপ্তাহখানেক ধরেই কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস প্রাঙ্গণে অন্যরকম এক পরিবেশ বিরাজ করছে। পাসপোর্টের জন্য শত শত মানুষ বসে আছেন। দিন শেষে ফিরে যাচ্ছেন। পরেরদিন আবার আসছেন কিন্তু পাসপোর্ট পাচ্ছেন না।
এদের একজন মো. তারেক। গত কয়েকদিন ধরে কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আসা-যাওয়ার মধ্যে আছেন তিনি। ৩৩ বছর বয়সী তারেকের বাড়ি মহেশখালী। কয়েকদিন আগে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছেন তিনি। যাবতীয় কাগজপত্রও রয়েছে।
কাগজপত্র সব সঠিক থাকলেও পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়ে তারেক বলেন, দালাল না ধরে নিজে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার পর ভুল ধরে কর্মকর্তারা সেটি গ্রহণ করেন না। আবার সংশোধন করে জমা দিলে আরেকটি ভুল ধরা হয়। এভাবে ভুল শুধরে আবেদন জমা দিতে দিনের পর দিন ছোটাছুটি করতে হয়। তবে দালাল ধরে আবেদন করলে আবেদনপত্রে বিশেষ চিহ্ন দেওয়া থাকে। তখন ভুল ধরা হয় না। এতে একদিনেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ছবি তোলার সুযোগসহ দ্রুত পাসপোর্ট পাওয়া যায়।
শুধু তারেক নন, দালাল ছাড়া পাসপোর্ট করতে গেলে এমন বিড়ম্বনায় পড়ার কথা জানিয়েছেন অন্তত অর্ধশত ভুক্তভোগী।
তারা বলেছেন, এই পাসপোর্ট কার্যালয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন আবেদনকারীরা। প্রতিদিন শত শত মানুষ পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। এর মধ্যে বেশিরভাগ দালালের শরণাপন্ন হন। এতে সরকারি ফির অতিরিক্ত খরচ হয় ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। কোনও জটিলতা থাকলে পাসপোর্ট পেতে আরও বেশি টাকা দিতে হয়। দালাল না ধরে নিজে পাসপোর্টের আবেদন করলে জমা দেওয়া এবং ডেলিভারি বুথে হয়রানির শিকার হতে হয়। হয়রানির অভিযোগ জানাতে কর্মকর্তা (এডি) মোবারক হোসেনের সাক্ষাৎও পান না তারা। কখনো সাক্ষাৎ পেলে তিনি দেখান নানান যুক্তি। এক প্রকারে এডি মোবারক নিজেই দালাল ধরতে বাধ্য করেন সেবা প্রার্থীদের।
জানা গেছে, কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক মোবারক হোসেনের আচরণ অনেকটা সামন্ত প্রভুর মতো। তার নির্দেশ ছাড়া পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে বাইরে পান থেকে চুনও খসে না।
সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নের বাসিন্দা হাবিব উল্লাহ বলেন, ‘সম্প্রতি পাসপোর্টের জন্য আবেদন জমা দিই। সকাল ১০টায় আবেদনপত্র নিয়ে লাইনে দাঁড়াই। দায়িত্বরত আনসার সদস্য ও দালালরা কিছুক্ষণ পরপর এসে বলেন, কষ্ট করে দীর্ঘ সময় লাইনে না দাঁড়িয়ে আমাদের দেন। দ্রুত কাজ হয়ে যাবে। ডেলিভারি দ্রুত পাবেন। এ জন্য প্রথমে দুই হাজার টাকা চাওয়া হয়। পরে এক হাজার টাকা চান। আমি তখন তাদের বলেছি, কষ্ট হলেও নিজেই জমা দেবো।’
কক্সবাজার শহরের কলাতলী এলাকার বাসিন্দা মো. রুবেল বলেন, ‘দালাল ছাড়া এখানে কোনও কাজ হয় না। আবেদন জমা দিতে দালালদের সর্বনিম্ন দুই হাজার টাকা দিতে হয়। তাদের মাধ্যমে গেলে অফিসের কর্মকর্তারা আবেদনপত্রে বিশেষ চিহ্ন দেখে বুঝতে পারেন। কারণ আবেদনে বিশেষ সংকেত দেওয়া থাকে। তখন দ্রুত কাজ হয়। অন্যথায় নানা ভুল ধরেন। ফরম নিতে গড়িমসি করেন। এতে হয়রানির শিকার হতে হয়।’
রুবেলের অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। গত ১১ অক্টোবর কক্সবাজারে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গণশুনানিতে নাম প্রকাশ না করে পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ বাণিজ্য ও দালাল চক্রের বিষয়ে অভিযোগ করেন এক ব্যক্তি।
এসময় পাসপোর্ট অফিস কর্মকর্তা মোবারকের উদ্দেশ্যে দুদক কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘কিছু রোহিঙ্গা পাসপোর্ট পেয়ে গেছে। কিছু আবেদনকারী হয়রানির শিকার হচ্ছে। পাসপোর্ট অফিসের হয়রানি নতুন নয়। সব পাসপোর্ট অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্য থাকে। আপনার আত্মীয়স্বজনের কাছে জিজ্ঞেস করেন, পাসপোর্ট করতে কী পরিমাণ হয়রানি পোহাতে হয়। পাসপোর্টে সমস্যা আছে এটা প্রমাণিত। হয়রানি করা যাবে না।’
তবে দুদক কর্মকর্তার সেই নির্দেশনা ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। ছিটে ফোটারও পরির্বতন আসেনি পাসপোর্ট অফিসে। সেবা প্রার্থীদের অভিযোগ, সেদিন দুদক কার্যত ব্যবস্থা না নেওয়ায় পাসপোর্ট অফিসের এডি ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। ওই অফিসে পান থেকে চুন খসলেই একটি কমিশন এডি মোবারকের হাতে চলে যায়। না হলে ভয়ংকর সমস্যায় পড়তে হয় অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
গত বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) সরেজমিনে কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, প্রবেশপথে লোকজনের জটলা। এখানে এলেই কে কোন কারণে এসেছেন, তা জানতে চান দালালরা। তারা আবেদনকারীদের বলছেন, দ্রুত সময়ে পাসপোর্ট পেতে সহায়তা করতে পারবেন। এ জন্য এক থেকে দুই হাজার টাকা চান।
এঝাড়াও নতুন পাসপোর্ট করতে ও পুরনো পাসপোর্ট নবায়নের জন্য মানুষ ভিড় করছে। তাদের ঘিরে ধরেছে আনসার সদস্য ও দালালরা। কম সময়ে পাসপোর্ট পাইয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে চুক্তিতে পাসপোর্ট সরবরাহের দায়িত্ব নিচ্ছে তারা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগের সূত্রে আবেদনকারী সেজে এ প্রতিবেদক কথা বলেন পাসপোর্ট অফিসের আরমান নামক এক আনসার সদস্যের সঙ্গে। পাসপোর্টের আবেদন করতে কত টাকা লাগবে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি দ্রুত করতে ১২ হাজার টাকার কথা বলেন। এর মধ্যেই অফিস ‘ম্যানেজ’ হয়ে যাবে এবং পুলিশ ভ্যারিফিকেশন আবেদনকারীকেই করতে হবে বলেও জানান তিনি। কাগজপত্রে কোনো ত্রুটি থাকলে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকাও লাগতে পারে বলে জানান এ আনসার সদস্য।
আরমান আরও বলেন, আমাদের প্রতিদিনের টাকাগুলো দিন শেষে উপরের স্যারকে (এডি) বুঝিয়ে দিতে হয়।
পাসপোর্ট অফিসের গেইটে মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন উখিয়ার বৃদ্ধ নজির আহাম্মদ। তার সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের। এসময় তিনি বলেন, ‘সব কাগজপত্র ঠিকঠাক করে মেয়ের পাসপোর্টের জন্য নিজেই আবেদন করি। কিন্তু ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলছে না বলে বার বার আমাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উপ-পরিচালক মোবারকের কাছে গেলে তিনি রেগে গিয়ে আরও নানা রকম হুকমি দিচ্ছেন। এখন বাধ্য হয়ে দালালের কাছেই যেতে হবে।’
পাসপোর্ট কার্যালয়ের পাশের দুই দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গেটের সামনে বসে থাকা ব্যক্তিরা দালাল। প্রতিদিন সেবাপ্রার্থীদের নানা কাজে সহায়তা করে অর্থ নেন। মাঝেমধ্যে প্রশাসনের অভিযান হলে সটকে পড়েন। কিছুদিন কার্যালয়ের আশপাশে আসেন না। নতুন পরিচালক মোবারক হোসেন যোগদানের পর দালালদের দৌরাত্ম্য আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এতে পাসপোর্ট করতে আসা ব্যক্তিরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
গেট থেকে ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেলো কার্যালয়ে আসা সেবাপ্রার্থীদের দুটি দীর্ঘ লাইন। এর মধ্যে একটি লাইনের লোকজন পাসপোর্টের জন্য আবেদন জমা দেবেন। অপর লাইনের লোকজন পাসপোর্ট ডেলিভারি নেবেন। এর মধ্যে ডেলিভারি লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন মো. নজরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি।
তিনি বলেন, ‘পাসপোর্ট ডেলিভারি নেওয়ার জন্য বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় লাইনে দাঁড়িয়েছি। এখন বেলা আড়াইটা। এখনও আমার সামনে অর্ধশতাধিক লোক দাঁড়ানো। একটু পরপর পুলিশ সদস্য ও দালালরা এসে বলছেন, ৫০০ টাকা দেন, দ্রুত পাসপোর্ট এনে দেবো। এর আগে সকাল থেকে অনেকে টাকা দিয়ে আগেভাগে পাসপোর্ট নিয়ে গেছেন। ফলে আমরা যারা টাকা দিইনি, তারা পেছনেই পড়ে আছি।’
এসব অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ করার জন্য পরিচালকের অফিসে গেলে তিনি দেখা দেন না উল্লেখ করে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘উপ-পরিচালকের তদারকির অভাবে কার্যালয়ের কর্মকর্তারা অনিয়ম-দুর্নীতি করছেন। হয়তো তিনিও এই কাজে জড়িত, এ জন্য অভিযোগ দিতে গেলেও সাক্ষাৎ দিচ্ছেন না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের জেরে দুদক ও জেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে দুজন দালালকে আটক করে। তাতেও স্বস্তি মেলেনি। নতুন উপ-পরিচালক মোবারক হোসেন যোগদানের পর দালালরা পাসপোর্ট অফিসের বাইরে এবং ভেতরে ঢুকে তাদের অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
দালালরা এডি মোবারকের আশ্রয়ে সশরীরে যে পাসপোর্ট অফিসে প্রবেশ করছে শুধু তাই নয়, পাসপোর্ট অফিসের অদূরে অফিস বানিয়ে নির্বিঘ্নে কাজও করছে। প্রশাসনকে পাহারা দিতে পাসপোর্ট অফিসে বসে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক নজরদারি চালায় উপ-পরিচালক। প্রশাসন আসার খবরটি তিনিই জানিয়ে দেন, যাতে দালালরা দ্রুত সটকে পড়তে পারেন। এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
ভুক্তভোগীরা জানান, ব্যক্তিগতভাবে পাসপোর্ট করতে গেলে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয় সাধারণ নাগরিকদের। দালাল ছাড়া পাসপোর্টের জন্য আবেদন করা ও পাসপোর্ট পাওয়া দুঃসাধ্য। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল থেকে আসা লোকজন চরম ভোগান্তির শিকার হন।
অভিযোগ রয়েছে, উপ-পরিচালক মোবারকের নির্দেশে কয়েকজন আনসার সদস্য দালালদের সঙ্গে লেনদেন করেন। প্রতিটি পাসপোর্ট করে দেওয়ার জন্য সরকারি ফি বাদে গ্রাহকদের কাছ থেকে ১ থেকে ২ হাজার টাকা বেশি নেওয়া হয়। এই টাকা পাসপোর্ট গ্রহণকারীর কাছ থেকে সরাসরি নেওয়া হয় না। দালালের মাধ্যমে নেওয়া হয়।
জনি নামে এক দালাল বলেন, কাস্টমারদের কাছ থেকে আমরা যে টাকা নিই, তার বেশিরভাগই অফিসে দিয়ে দিতে হয়। আমরা প্রতি পাসপোর্টে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত পাই। এখানে ছোট-বড় সবাই টাকা খায়। দায়িত্বরত পুলিশ ও আনসার সদস্যরাও পাসপোর্টের দালালি করে। তবে টাকার বড় একটা অংশ উপ-পরিচালক মোবারকের কাছে চলে যায়।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক মোবারক হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে তার অফিসে গেলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। পুনরায় চেষ্ট করা হলে তিনি রেগে যান এবং বলেন, ‘আপনাদের জন্য কোনো কাজ করতে পারছি না। আপনারা যান তো।’
এর আগে, দালাল না ধরলে পদে পদে হয়রানির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘টাকার বিনিময়ে লাইনে দাঁড়ানো কারও পাসপোর্টের আবেদন জমা কিংবা পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে কিনা, তা আমার জানা নেই।’
আবেদনপত্রে অযথা ভুল ধরার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি ক্ষেপে যান এবং কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নয়া শতাব্দী/এসএম/একে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ