ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মেলায় জামাই-শ্বশুরের মাছ কেনার প্রতিযোগিতা

প্রকাশনার সময়: ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১৯:৫৭ | আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ২০:০৬

গাজীপুরের কালীগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আবার অনেকে এই মেলাকে জামাই মেলাও বলে থাকেন। মেলার আশপাশের এলাকায় যারা বিয়ে করেছেন, সেসব জামাই ও তাদের শ্বশুর মূলত এখানকার ক্রেতা। শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যেতে এবং জামাইকে আপ্যায়ন করতে বড় মাছ কেনার জন্য এ মেলায় আসেন তারা। এতে মেলায় জামাই-শ্বশুরের মাছ কেনার প্রতিযোগিতা হয়।

সোমবার (১৫ জানুয়ারি) উপজেলার বিনিরাইল গ্রামে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

জামা-শ্বশুর ছাড়াও পছন্দের মাছ কিনতে অনেকে দূর দুরান্ত থেকে আসেন এ মেলায়। এতে উৎসবমূখর হয়ে উঠে মেলার পরিবেশ। সারা দিনব্যাপী বড় বড় মাছের দাম নিয়ে চলে ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাক ডাক।

এবারের মেলার প্রধান আকর্ষণ ছিল ৭০ কেজি ওজনের বাঘাইড় মাছ। এই বাঘাইড় মাছকে ঘিরে ক্রেতাদের জটলা লেগে থাকে। বিক্রেতা মাছটির দাম হেঁকেছেন ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। ক্রেতাদের মধ্যে স্থানীয় এক জামাই মাছটির দাম সর্বোচ্চ ৮৫ হাজার টাকা বলেন। কিন্তু বিক্রেতা আরও বেশি দাম পাবার আশায় মাছটি ছাড়েননি। পরে চলে দর কষাকষি। যত না ক্রেতা তার চেয়ে অনেক বেশি উৎসুক জনতা ভিড় জমান মাছটি দেখার জন্য।

বিনিরাইলের মাছের মেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি জানান, কালীগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুর, জাঙ্গালিয়া, মোক্তারপুর ও জামালপুর ইউনিয়ন চারটির চারমোহনার বিনিরাইল গ্রামে এই মেলাটি প্রথম অনুষ্ঠিত হতো খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে, এটি অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ সংক্রান্তি ও নবান্ন উৎসবে আয়োজন করা হতো। প্রায় ২৫০ বছর যাবৎ মেলাটি পৌষ সংক্রান্তিতে মাঘ মাসের প্রথমদিনে এ মেলাটি আয়োজন হয়ে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ মেলাটি একটি সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। প্রতিবছর মাছ মেলাকে ঘিরে দূর-দূরান্ত থেকে মাছ কিনতে আসা আগত মেয়ে জামাই ও উৎসুক দর্শনার্থীরা ভিড় জমান মাছ মেলায়।

মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জানান, ব্রিটিশ শাসনামল থেকে বিনিরাইলের মাছের মেলা এখন ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। এ মেলা কালীগঞ্জের সবচেয়ে বড় মাছের মেলা হিসেবে স্বীকৃত।

এলাকার জামাইরা জানান, শ্বশুরবাড়িতে মাছ নিয়ে যাওয়া বলে কথা। তাই এলাকার সকল জামাইদের নজর বিনিরাইলের মাছের মেলার বড় মাছটার দিকেই। ফলে স্থানীয় বড় মাছ ব্যবসায়ীরা সপ্তাহখানেক ধরে বড় বড় মাছ সংগ্রহ করে থাকেন। সেই অনুযায়ী মাছের দামও হাঁকানো হয়।

তারা জানান, বিনিরাইল গ্রামের মাছের মেলাকে ঘিরে আশপাশের কয়েক জেলার মানুষের সমাগমে মেলায় সোমবার দিনভর চলে আনন্দ-উৎসব। বলাটা খুব বেশি অযৌক্তিক হবে না, এই মেলায় আছে একের ভেতর দুই। এক কথায় রথ দেখা আর কলা বেচা। কারণ এটা মাছের মেলা হলেও, এখানে চলে এলাকার জামাইয়ের মাছসহ সবকিছু বড় কেনার প্রতিযোগিতা। বিনিরাইল এবং এর আশপাশে গ্রামে যারা বিয়ে করেছেন, সেসব জামাইরা হচ্ছেন ওই মেলার মূল ক্রেতা ও দর্শনার্থী। তা ছাড়া এই মেলাকে ঘিরে এলাকার শ্বশুরদের মধ্যেও চলে এক নীরব প্রতিযোগিতা। কোনো জামাই সবচেয়ে বড় মাছটি ক্রয় করে শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যেতে পারে। আবার শ্বশুররাও চান সবচেয়ে বড় মাছটি ক্রয় করে জামাই আপ্যায়ন করতে পারে।

মেলার আয়োজক ও স্থানীয়রা জানান, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ থেকে অনেক মানুষ কেবল এই মেলা উপলক্ষ্যেই কালীগঞ্জে এসেছেন। এবারের মেলায় প্রায় ৩ শতাধিক মাছ ব্যবসায়ী বাহারি মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন।

মাছের মেলায় সামদ্রিক চিতল, বাঘাড়, আইড়, বোয়াল, কালী বাউশ, পাবদা, গুলসা, গলদা চিংড়ি, বাইম, কাইকলা, রূপচাঁদা মাছের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে নানা রকমের দেশী মাছও। মেলায় মাছ ছাড়াও আসবাবপত্র, খেলনা, মিষ্টি ইত্যাদির পসরাও বসেছে।

বিনিরাইলের মাছের মেলা নিয়ে কথা হয় মেলা সংলগ্ন জামালপুর ইউনিয়নের কাপাইস গ্রামের জামাই মো. হোসেন আলীর সঙ্গে।

তিনি জানান, এবার সাড়ে ১৭ হাজার টাকার চিতল, বোয়াল, আইড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কিনেছেন শশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। শুরুতে এ মেলা শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য হলেও, বর্তমানে এটা সকল ধর্মের মানুষের কাছে ঐতিহ্যর উৎসবে পরিণত হয়েছে।

ঐতিহ্যবাহী এ মেলা সম্পর্কে স্থানীয় জামালপুর ইউপি চেয়ারম্যান জানান, মাছের মেলাটি এ অঞ্চলের ঐতিহ্যের ধারক। মেলায় বেচাকেনা যতই হউক, এ মেলা আমাদের ঐতিহ্য আর কৃষ্টি-কালচারকে বহন করছে, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে বিনিরাইলের মাছের মেলা এখন ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। এ মেলা কালীগঞ্জের সবচেয়ে বড় মাছের মেলা হিসেবে স্বীকৃত। ঐতিহ্যেবাহী এই মেলায় প্রায় ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার মাছ ক্রয় বিক্রয় হয়।

কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা থেকে মেলায় আসা মাছ ব্যবসায়ী নয়ন কুমার দাস জানান, তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে এই মেলায় দোকান করেন। বিনিরাইলের পাশেই চুপাইর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বসে তিন দিনব্যাপী মাছের এ মেলা। এবার মেলায় প্রচুর দেশি রুই, কাতল, বোয়াল, আইড়, বাঘাইর, চিতল, কালবাউশ ও রিটা মাছের সমাগম হয়েছে। এ ছাড়া কার্প জাতীয় নানা মাছের আমদানি হয়েছে। এক কেজি থেকে শুরু করে বিশ কেজি পর্যন্ত এসব মাছের দাম হাঁকা হচ্ছে ৪০০ টাকা থেকে শুরু করে ৬৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। বিক্রিও হচ্ছে প্রচুর। সামর্থ অনুযায়ী ক্রেতারা এসব মাছ কিনছেন।

বিনিরাইলের মাছের মেলা নিয়ে কথা হয় কলাপাটুয়া গ্রামের মতিউর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, এবার সাড়ে ১৫ হাজার টাকার চিতল, বোয়াল, আইড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কিনেছেন।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ