সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসে দালালচক্রের হাতে জিম্মি গ্রাহকরা

প্রকাশনার সময়: ০৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১৬:০৪ | আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১৬:১১

চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ উঠেছে। দ্রুত কাজ হতে দালালরা গ্রাহকদের সঙ্গে চুক্তি করে ফরমে একটি সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে পাসপোর্ট অফিসে জমা দেন। সেই সংকেত দেখে অফিসের কর্মকর্তারা কাজ করেন। কয়েকেজন পাসপোর্ট গ্রহীতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

অফলাইনে পাসপোর্টের আবেদন জমা নেওয়ার কোনো নিয়ম নেই কোনো পাসপোর্ট অফিসে। অনলাইনে করতে হয় পাসপোর্টের সব আবেদন। কিন্তু এই নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রতিদিন হাজারো পাসপোর্টের আবেদন নেয়া হচ্ছে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের অবস্থিত জেলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে। এজন্য সরকারি নির্ধারিত ফি অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে ১৮০০ টাকা। যা দালালদের মাধ্যমে নেওয়া হচ্ছে। অতিরিক্ত টাকা আদায়ের পর দালালরা আবেদনে মার্কার বা সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে আবদনপত্র জমা দেয়ার জন্য পাঠায় পাসপোর্ট অফিসে।

আবেদনকারীর তথ্যমতে, দালালে ভরা চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিস। যাদের অনেকে কাজ করেন সরকারি কর্মকর্তার চেয়ারে বসে। এই দালালদের মার্কার বা সাংকেতিক চিহ্ন ছাড়া মিলে না পাসপোর্ট। যার প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক দালাল বলেন, সাধারণ পাসপোর্ট করতে ব্যাংক ড্রাফট ও আনুষঙ্গিক কিছু খরচসহ পাঁচ হাজার ৮০০ টাকা লাগে। সেক্ষেত্রে আমরা ৮হাজার কখনো ৮ হাজার ৪০০ টাকা নিই। এছাড়া জরুরিভাবে পাসপোর্ট করতে ৮ হাজার ১০০ টাকা লাগে। আমরা সেক্ষেত্রে ১০ হাজার বা কারো কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা নিয়ে থাকি।

কিছুদিন আগে দালালের মার্কা ছাড়া আবেদন করে পাসপোর্ট করতে গিয়ে পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালকের (এডি) হাতেও চরমভাবে হয়রানি ও শারীরিকভাবে লাঞ্চিত হন একজন চট্টগ্রামের স্থানীয় সাংবাদিক।

এবিষয়ে জানতে কয়েকজন ভুক্তভোগী গ্রাহক বলেন, দালালের মার্কা ও সাংকেতিক চিহ্ন ছাড়া পাসপোর্ট করাতে এসে সাংবাদিক লাঞ্চিত হয়েছেন। সেখানে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের অবস্থা কি সেটা বলার দরকার আছে?

এদিকে এই অফিসে পাসপোর্ট করাতে আসেন মোহাম্মদ রাশেদ নামে এক ব্যক্তি। পাসপোর্টের আবেদন কিভাবে করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, দালাল ছাড়া পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলে তো আর পাসপোর্ট পাওয়া যায় না। তাই দালাল ধরে আবেদন করেছি। তিনি বলেন, সকালে নগরীর আন্দরকিল্লায় অনলাইনে আবেদন করে প্রিন্ট কপি নেওয়া হয়। সে কপিতে দালাল একটি সিল মেরে দেয়। এটিই তার মার্কার। এই কপি জমা দিতে এসেছি। আবেদনের কপির ছবি নিতে চাইলে তিনি অনুনয়-বিনয় করে বলেন, ভাই আমার ক্ষতি করিয়েন না। আপনি তাদের বিরুদ্ধে পত্রিকায় সংবাদ ছাপালে আমি আর পাসপোর্ট পাব না।

রাকিব নামে আকেজন ভুক্তভোগী বলেন, আমিও দালাল ছাড়া আবেদন জমা দিতে এসেছি। ১০ বছর মেয়াদের পাসপোর্টের জন্য করা এই আবেদন কপি উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখে তারা বলেন, আবেদন না কি ভুল হয়েছে। অফলাইনে তারা আবেদন করতে বলেন। আবেদন ঠিকভাবে করতে তারা খোকন নামে একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। তার সঙ্গে দেখা করার পর সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে আরও ১৮০০ টাকা নেন তিনি।

ভুক্তভোগীরা জানান, চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পাসপোর্ট করা নিয়ে শত শত দালাল সক্রিয় রয়েছে ২০-৩০ জন সংঘবদ্ধ দালালচক্র। যারা পাপোর্ট অফিসের ডেস্কে বসে কাজ করেন। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন শহীদুল ইসলাম খোকন ওরফে খোকন, রিদোয়ান, রুহুল আমিন, রিপন, বাবুল, টিটু, ও ইদ্রিস। যাদের মার্কার ছাড়া পাসপোর্ট মিলে না এই অফিসে। দালালরা সত্যায়নের নামে মার্কার হিসেবে ব্যবহার করেন ডাক্তার বা ব্যাংকারদের সিল।

তাদের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, দালাল শহীদুল ইসলাম খোকন ৩০৪ নম্বর কক্ষে সরকারি কর্মকর্তার মতো চেয়ারে বসে দালালির কাজ করছেন। রুহুল আমীন কাজ করেন ৩০৭ নম্বর রুমে। তবে সাংবাদিকদের উপস্থিতির খবর ছড়িয়ে পড়লে অন্য দালালরা সটকে পড়েন।

এসময় এক দালাল ক্ষুদ্ধ হয়ে বলেন, আমরা এখানকার ডেইলি লেবার। এখানে আমরা এমনে -এমনে আসিনি। অনেক চড়াই-উতড়াই শেষে এসেছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সুযোগ না দিলে কি আমরা এখানে আসতে পারতাম না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাসপোর্ট অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, অফিসের ভেতরে কাজ করেন এমন অন্তত ১৫-২০ জন দালাল রয়েছে। এদের অধিকাংশই এক সময় এই অফিসে আনসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ অবস্থায় দালালির কারণে তাদের চাকরি চলে যায়। কিন্তু পাসপোর্ট অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাদের ডেকে বসিয়ে দালালি করার সুযোগ করে দেয়। এর মধ্যে দালাল ইদ্রিস আনসার হিসেবে কর্মরত আছেন।

সূত্রমতে, পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন অফলাইনে এক হাজার থেকে ১২০০ পর্যন্ত আবেদন জমা পড়ে। প্রতিটি আবেদন থেকে দালালের মাধ্যমে অতিরিক্ত ১৮০০ টাকা আদায় করা হয়। আবেদনের প্রতিটি থেকে ১২০০ টাকা উপ-পরিচালকের পকেটে চলে যায়। সে হিসেবে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বাকি আবেদনের ৫-৬ লাখ টাকা ভাগ করে নেন সহকারী পরিচালক, রেকর্ড কিপার ও দালালচক্ররা। এছাড়া এমআরপি (মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট) আবেদন বন্ধ থাকলে ও নেয়া হচ্ছে সেই আবেদনও। যেখান থেকে প্রতিটি আবেদনে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এমনকি জরুরি পাসপোর্টের আবেদনেও সমপরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পাঁচলাইশ উপপরিচালক তারিক সালমান বলেন, অভিযোগগুলো সত্য নয়। কেউ যদি এভাবে টাকা পয়সা চেয়ে থাকেন ভুক্তভোগী যে কেউ আমার ২০৭ নম্বর কক্ষে এসে কথা বলতে পারেন। আর পাসপোর্ট অফিসের কোনো কর্মকর্তা দালালদের সাথে অনৈতিক কোনো কাজে জড়িত থাকার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নয়া শতাব্দী/এসএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ