শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১

ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিলে দিশেহারা ওয়ার্কশপ দোকানি

প্রকাশনার সময়: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৭:২০

কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সদর দপ্তরের ভুতুড়ে বিলের কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যা দেখে গ্রাহকের চোখ ছানাবড়ার মতো অবস্থা। ৪-৫ গুণ বেশি বিল এসেছে অনেকের। ১৩ হাজার টাকার বিদ্যুৎ বিল হয়েছে ৪৮ থেকে ৫০ হাজার টাকা। আর ৬২ হাজার টাকার বিল ২ লাখ ২৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিকার চেয়ে বিদ্যুৎ অফিসের কর্তাবাবুদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন হাজারো ভুক্তভোগী।

কিভাবে হলো এমন বিল? এ প্রশ্নের জবাব নেই কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির। তবে গ্রাহকরা বলছেন, ভুতুড়ে বিল দিয়ে গ্রাহকদের পকেট কাটছে যেমন তেমনই হয়রানি আরও বাড়ছে।

ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, ভুল করে নয়, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েই বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিল করেছে কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুত সমিতি। এর অন্যতম লক্ষ্য বাড়তি রাজস্ব দেখিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পারফরম্যান্স বোনাস নেওয়া। তাদের এমন কারসাজিতে ভুতুড়ে বিলে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন পল্লী বিদ্যুত সমিতির গ্রাহকরা। এ সমস্যার সমাধান ও অভিযোগ করতে গিয়ে কক্সবাজার সদর দপ্তর পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের তোপের মুখে পড়তে হয় গ্রাহকদের। তাদের অসৌজন্যমূলক আচরণ ও হুমকিতে গ্রাহকরা নিরুপায় হয়ে পড়েছেন।

এমন এক ভুক্তভোগীর নাম গিয়াস উদ্দিন। তিনি ঝিলংজার পূর্ব মুক্তারকুল ভাঙ্গাব্রিজ সংলগ্ন একটি ওয়ার্কশপের দোকান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রতিবেদকের হাতে আসা তার কয়েকটি বিলের কপি ও অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত জুলাই মাসে আগের ইউনিট ৫৬৪০ ও বর্তমান ইউনিট ২৪৭১০ দেখিয়ে এবং ব্যবহার করা ১৯০৭০ ইউনিট দেখিয়ে পল্লী বিদ্যুতের বিল প্রস্তুতকারী শিখা ২ লাখ ৮২৭ টাকার মনগড়া বিল তৈরি করে দেন। এমতাবস্থায় বিষয়টি নিয়ে জেনারেল ম্যানেজার বরাবর তিনি লিখিত অভিযোগ করলে টাকার পরিমাণ কমিয়ে ৬২ হাজার ৭৪৮ টাকার আরেকটি নতুন বিল তৈরি করে দেন।

পরে ওই টাকা পরিশোধ করে সেবার কোন রকম নিস্তার পান গিয়াস। তবে সেটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পরের মাসে দেয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আরেকটি বিলে দেখা যায়, জুলাই মাসের ২৪৭১০ ইউনিট থেকে আগস্ট মাসে দাঁড়িয়েছে ১১২৭১৫ ইউনিট। সেখানে ৩৮৫৬ ইউনিট ব্যবহার দেখিয়ে যার বিল করা হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৮ টাকা।

ভুক্তভোগী গিয়াস উদ্দিন বলেন, বিগত দিনে ৪০ থেকে ৫০ হাজার করে মাসিক বিদ্যুৎ বিল আসে। যা নিয়মিত পরিশোধ করে আসছি। হঠাৎ এক লাফে মিটারের ইউনিট ২৪ হাজার থেকে ১১ লাখে চলে গেলো; কেন এতো বিল হল জানতে এ বিষয় কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুত অফিসে গেলে ক্ষিপ্ত হয়ে যান সেখানকার কর্মকর্তারা। যুক্তিসংগত কারণ না দেখিয়ে উল্টো চড়াও হয়ে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে তাড়িয়ে দেন। বিষয়টি নিয়ে পুনরায় লিখিত অভিযোগ দিলে তারা আর কর্ণপাত করেনি।

তিনি আরও বলেন, ওই বিলটির সমাধান নিয়ে পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো সমাধান পাইনি। উল্টো তার উপর আক্টোবর মাসে ১ লাখ ৩৩ হাজার টাকার আরও একটি ধরিয়ে দিয়ে বিদ্যুতের সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

ভুতুড়ে বিলের এত টাকা কিভাবে দেবে; না হলে তার আয়ের একমাত্র উৎস এ দোকান বন্ধ হয়ে যাবে দুশ্চিন্তায় তার দু’চোখে অমানিশার ঘোর অন্ধকার নেমে আসে বলে জানান গিয়াস।

বিষয়টি নিয়ে পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে যায় এই প্রতিবেদক। অফিসের সামনে কথা হয় বিষন্ন চেহারায় দাঁড়িয়ে দিনমজুর ফরিদুল আলমের সাথে। তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার বিল প্রতিমাসে পরিশোধ করে আসছি। কিন্তু এই মাসের একটি বিলে বকেয়া মাস দাবি করে ৩০০ টাকার বেশি যোগ করে দেয়া হয়েছে। প্রতিমাসে বিল পরিশোধ করার পরও এই ৩০০ টাকা কিসের জানতে চাইলে তারা সেটি ২০২০ সালের টাকা বলে দাবি করছে। অথচ আমার কোনো বকেয়া নেই।

জানা গেছে, কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সদর দপ্তরের আওতায় রয়েছে প্রায় ৪৮ হাজার গ্রাহক। প্রতি মাসে এসব গ্রাহকের ব্যবহৃত বিদ্যুতের বিল লিখে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয় বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। বিদ্যুৎ ব্যবহারের শুরুর পর থেকে বিগত বছর থেকে বিল বাড়ানো হচ্ছে। কেউ কেউ কয়েক বছর থেকে ভুতুড়ে বিলের বোঝা টেনে বেড়াচ্ছেন। ভুতুড়ে এমন বিল সংশোধন করতে গেলে নেসকোর কর্মকর্তা, কর্মচারীদের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন গ্রাহকরা। টেবিলের পর টেবিল ঘুরেও মিলছে না ভুতুড়ে বিলের সমাধান।

কায়সার ও সোহেল নামের দুজন গ্রাহক জানান, বিদ্যুৎ ব্যবহারের পর থেকেই প্রতি মাসে সহনীয় বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে আসছি। কিন্তু হঠাৎ প্রতিটি মাসে ২-৩ গুণ বেশি বিদ্যুৎ বিল আসে। সংশোধনের জন্য বিদ্যুৎ অফিসে গেলেও কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্ব্যবহারে ২য় বার সংশোধন করাতে মন চায় না। তা ছাড়া বিল সংশোধনের জন্য চাপ দিলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করারও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে বাধ্য হয়েই ভুতুড়ে বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে।

কবির ও মনছুর নামে দুই গ্রাহক জানান, করোনা মহামারি শুরুর দিকে প্রতি মাসে ৬০০-৭০০ টাকা বিল এসেছিল। দুটি ফ্যান, একটি টেলিভিশন ও চারটি লাইট জ্বালিয়ে এখন বিল আসছে ১৪০০ থেকে ১৮০০ টাকা পর্যন্ত।

আকলিমা নামের একজন জানান, তিনি বাসায় একা থাকেন এবং একটি লাইট ও একটি ফ্যান ছাড়া কিছুই চালান না। এরপরও গত এক বছরে তার প্রতি মাসে প্রায় ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা ভুতুড়ে বিল দিয়ে যান এবং বাধ্য হয়ে তাকে এ বিল পরিশোধ করতে হয়।

জনশ্রুতি রয়েছে, ভুল করে নয়, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েই বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিল করেছে কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুত সমিতি। এর অন্যতম লক্ষ্য বাড়তি রাজস্ব দেখিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পারফরম্যান্স বোনাস নেওয়া। এছাড়া সদরের বিভিন্ন এলাকায় অটোরিকশা ও চার্জার রিকশার গ্যারেজ রয়েছে প্রায় শতাধিকের মতো। কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ওইসব গ্যারেজে মাসিক চুক্তির বিনিময়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছেন। সেখানে পর্যাপ্ত ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাধারণ গ্রাহকের ঘাড়ে। এ নিয়ে কর্মকর্তা ব্যক্তিদের অভিযোগ দিয়েও সুফল না পাওয়ায় একেবারেই অসহায় হয়ে পড়েছেন এই কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সদর দপ্তরের প্রায় সব বিদ্যুৎ গ্রাহক।

এ বিষয়ে কথা বলতে কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুতের জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী গোলাম আহম্মদের অফিসে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে দাম্ভিকতার সঙ্গে বলেন, এসব অভিযোগের ব্যাপারে গ্রাহকদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ