ঢাকা, রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ কার্তিক ১৪৩১, ৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অভিযান-১০ ট্র্যাজেডির দুই বছর, পরিচয় মেলেনি ৯ জনের

প্রকাশনার সময়: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮:৪৮

অভিযান-১০ লঞ্চ ট্র্যাজেডির দুই বছর পূর্ণ হলো আজ। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে এই দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান ৪৯ জন। এখনো শনাক্ত হয়নি ৯ জনের মরদেহ। সরকার থেকে সহায়তা করা হলেও ধরা-ছোয়ার বাইরে রয়ে গেছে লঞ্চ মালিক কর্তৃপক্ষ।

এই দিনেই ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে চলন্ত নৌ-যানটি শতশত যাত্রী নিয়ে পুড়ে যায় আগুনে। সুগন্ধা নদীর বাতাসে ছড়িয়ে পরে পোড়া মরদেহের গন্ধ। শোকের ছায়া নেমে আসে বরগুনাসহ সারা বাংলাদেশ জুড়ে। আগুনে দগ্ধ হয়ে নারী-শিশুসহ ৪৪৯ জনের প্রাণহানি হয়। দগ্ধ হয় আরও অসংখ্য মানুষ।

লঞ্চের চার মালিক, দুই ইনচার্জ মাস্টার, সুকানি, দুই ইঞ্জিনচালক ও চালকের সহকারীকে সরাসরি দায়ী করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন নৌ-মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে ইঞ্জিন ত্রুটিপূর্ণ থাকার পরও লঞ্চের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় কারণে নৌপরিবহন অধিদফতরের সদরঘাটের সার্ভেয়ার ও ইন্সপেক্টও এবং মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স সংক্রান্ত বিধিবিধান লঙ্ঘনের জন্য ইঞ্জিন পরিবর্তন করা ডকইয়ার্ডের মালিককেও দায়ী করা হয়েছিল।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার দুই দিন পর ২৬ ডিসেম্বর বরগুনার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে লঞ্চের মালিক হাম জালাল শেখকে প্রধান ও ২০/২৫ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন আইনজীবী নাজমুল ইসলাম নাসির ও নৌ আদালতে পৃথক আরেকটি মামলা করেন নৌপরিবহন অধিদফতরের প্রধান পরিদর্শক মো. শফিকুর রহমান।

মামলার আসামিরা হচ্ছেন- লঞ্চটির স্বত্ত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স আল আরাফ অ্যান্ড কোম্পানির চার মালিক মো. হামজালাল শেখ, মো. শামিম আহম্মেদ, মো. রাসেল আহম্মেদ ও ফেরদৌস হাসান, লঞ্চের ইনচার্জ মাস্টার মো. রিয়াজ সিকদার, ইনচার্জ চালক মো. মাসুম বিল্লাহ, দ্বিতীয় মাস্টার মো. খলিলুর রহমান ও দ্বিতীয় চালক আবুল কালাম।

গত বছরের ১৯ জানুয়ারি বুধবার এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নৌ আদালতের মামলায় কারাগারে থাকা সাত আসামির জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন নৌ আদালতের বিচারক স্পেশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জয়নাব বেগম।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অন্ধ হাফেজ মিরাজুল ইসলাম বলেন, আমি অসুস্থ বাবাকে চিকিৎসা শেষে ওই লঞ্চে সেদিন ফিরছিলাম বরগুনায়। আমার সাথে মা, আমার স্ত্রী ও সন্তান ছিল। কিন্তু অসুস্থ বাবাকে নিয়ে ফিরতে পারলাম না। বাবার মরদেহ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাবার মরদেহটাও যদি পেতাম তবুও সান্ত্বনা পেতাম। লঞ্চের সেই ঘটনা মনে হলে এখনো ভয় লাগে।

অভিযান-১০ ট্র্যাজেডিতে নিহত হাকিম শরিফ (৪৫) এর মা রতন বিবি জানান, ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন তার ছেলে। বাড়ি ফেরার সময় অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় স্ত্রী পাখি বেগম আর ১৬ মাস বয়সের শিশু সন্তান নাসরুল্লাহসহ নিহত হন হাকিম শরীফ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেসহ ৩ জনকে হারিয়ে এখনো নির্বাক রতনবিবি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাদের কোন হদিস মেলেনি। পরে ডিএনএ টেস্টের ফলাফলে শনাক্ত হয় এই তিনজনের মরদেহ। কিন্তু ডিএনএ টেস্টের ফলাফল প্রকাশের আট মাস পর এখনও বুঝিয়ে দেয়া হয়নি তাদের কবর।

পোটকাখালি গণকবর এলাকার বাসিন্দা মজিবুর রহমান জানান, প্রায় ২ বছর ধরে আমি গণকবরের পাশ দিয়ে যাতায়াত করে আসছি। কিন্তু কাউকে কখন পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজেও দেখিনি। গত বছর প্রশাসনের লোকজন যেভাবে দাফন করে গিয়েছে, সেভাবেই পড়ে আছে। অনেক কবরের পাশে রাখা সাইন্ডবোর্ডগুলো নিচে পড়ে গেছে। পাশাপাশি দেয়ালটির অবস্থাও ভালো নয়। প্রশাসনের কাউকেই কখনো নজরদারীতে দেখিনি। তাই এখানে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন মানুষ রাখা প্রয়োজন।

একই দুর্ঘটনায় এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ফজিলা আক্তার পপি। তার বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটার ছোট টেংরা গ্রামে। পপির মা আমেনা বেগম বলেন, আমরা কিছু চাই না শুধু আমার মেয়ের কবরটা চাই। জানিনা বেঁচে থাকতে আমাদের এই আশা পূরণ হবে কিনা। আমরা বেঁচে থাকতে আমাদের মেয়ে মারা গেল, এর থেকে কষ্টের বাবা-মায়ের আর কিছু থাকতে পারে না।

বরগুনা জেলা প্রশাসক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, শনাক্ত না হওয়া বাকি ৯ জনের মরদেহ শনাক্তের পাশাপাশি দোষীদের শাস্তি নিশ্চিতে কাজ করছে জেলা প্রশাসন।

উল্লেখ্য, ঢাকা সদরঘাট থেকে ছয় শতাধিক যাত্রী নিয়ে বরগুনার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় অভিযান-১০ লঞ্চ। ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর দিবাগত রাত ৩টার দিকে লঞ্চটি ঝালকাঠির সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর মোহনায় এলে ইঞ্জিন বিস্ফোরিত হয়ে পুরো লঞ্চে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে নদীতে লঞ্চটি জ্বলছিল। পরে সেটি ভাসতে ভাসতে দিয়াকুলের চরে এসে আটকা পড়ে। জীবন বাঁচাতে অনেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনায় ৪৯ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় ২১ জনের মরদেহ বরগুনার পোটকাখালি গণকবরে দাফন করা হয়। পরবর্তীতে পরিচয় মেলায় ৮ জনের মরদেহ তাদের পরিবার নিয়ে যায়। এ বছর বাকি মৃতদের মধ্যে ১১ জনের পরিচয় শনাক্ত হয়। বাকি স্বজনরা ডিএনএ নমুনা দিলেও। কিন্তু দুই বছর পূর্ণ হলেও শনাক্ত হয়নি মৃত ৯ জনের পরিচয়।

নয়া শতাব্দী/এসএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ