বর্তমান সরকারের সময়ে প্রাথমিক শিক্ষার অনেক উন্নয়ন হয়েছে। যেকোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেলেই চোখে পড়বে সরকারের উন্নয়ন। তবে ফরিদপুরের সালথা উপজেলার যদুনন্দী ইউনিয়নের ৪৩নম্বর কুমারকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেলে দেখা যায় প্রাথমিক শিক্ষা খাতে বর্তমান সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি রং করে শুধু ফিট দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র। শুধুমাত্র জমি নিয়ে বিরোধে থেমে রয়েছে স্কুলের সকল উন্নয়ন।
আধুনিককালে এমন জরাজীর্ণ পুরাতন স্কুলটি থেকে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা যেন মুখ ফিরিয়ে না নেয় এজন্য দ্রুত সকল সমস্যা সমাধান করে স্কুলটিকে আধুনিক হিসেবে গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও স্থানীয়রা।
জানা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৩ সালে ৭৬ শতক জমিতে গড়ে উঠে ৪৩নম্বর কুমারকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৯২ সালে একতলা ভবন নির্মাণ করা হয় এবং ২০১৩ সালে বর্তমান সরকারের সময়ে বিদ্যালয়টি রেজিস্ট্রার থেকে জাতীয়করণ হয়। ৫৪নম্বর জগন্নাথদী মৌজার ২৯৮৮ দাগে ৮৮ শতক জমি স্কুলের ১৪ শতক এবং ২৯৮৯ দাগে ১১০ শতক জমির মধ্যে স্কুলের ৬২ শতক। দুই দাগ মিলে স্কুলের মোট জমি ৭৬ শতক। তবে ২০১৩ সালে মৃত সামচু ফকির গং বাদী হয়ে মজিবুর রহমান গং ও বিদ্যালয়ের নামে মামলা দিলে বিপত্তি বাধে। এরপর থেকেই সব কিছু যেন চলে শুধু নিয়ম করে এর বেশি কিছু না।
সরেজমিনে দেখা যায়, স্কুলের মাঠে গরু বাঁধা রয়েছে, মাঠে রয়েছে অনেক গুলি গাছের লগ, স্কুল মাঠ খানা খন্দে ভরা, একদম খেলাধুলার অনুপোযোগী। মাঠের একপাশে বিদ্যালয়ের সাথে মিশিয়ে গোয়ালঘর নির্মাণ করেছে জমির মালিকানা দাবি করা মৃত সামচু ফকিরের শরিকরা। ২৩৩ জন শিক্ষার্থী ও ৪ জন শিক্ষকের জন্য একটি মাত্র টয়লেট। একজন ব্যবহার করলে অন্যজনকে অপেক্ষা করতে হয়। মাঝে মাঝে লোকসংখ্যা বাড়লে টয়লেট নিয়ে ভোগান্তি বেড়ে যায়।
১৯৯২ সালে নির্মিত ভবনটি যেন কঙ্কাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি হলে মাঝে মাঝে ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে। মাঝে মাঝে দেওয়ালের প্লাস্টার খসে পড়ে। শিক্ষার্থীরা সব সময় আতঙ্কে থাকে। জমি নিয়ে বিরোধে তৈরি হচ্ছে আরও অনেক সমস্যা। শিশুর মেধা বিকাশে বাঁধা হয়ে দাড়াচ্ছে এসব।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান বলেন, বিদ্যালয়ের জমি নিয়ে বিরোধ থাকার কারণে ওয়াস ব্লক নির্মাণ, আর্সেনিকমুক্ত টিউবওয়েল স্থাপন, একাধিক স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট স্থাপন, শহীদ মিনার, নতুন ভবন নির্মাণে সমস্যা হচ্ছে। একটি ভবন নির্মাণের কথা থাকলেও বিরোধ থাকার কারণে তা হয়নি। শেখ রাসেল কর্নার, প্রাক-প্রাথমিকের কক্ষ তৈরি করা যাচ্ছে না। বাগান করা ও বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতাসহ নানা সরকারের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যালয়ে ২৩৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হলে এই সংখ্যা ২৫০ ছাড়িয়ে যাবে। মাত্র ৩টি শেণিকক্ষে পাঠদান করাতে আমাদের সমস্যা হবে।
বিদ্যালয়ের সভাপতি মো. ফাইজুর রহমান বলেন, মামলা থাকার কারণে বিদ্যালয়ের উন্নয়নমূলক কোনো কাজই করা যাচ্ছে না। জমি নিয়ে কোনো বিরোধ না থাকলে পরিবেশটা আরও সুন্দর থাকতো। তাহলে দূর-দুরান্ত থেকে আরও অনেক শিক্ষার্থী এখানে আসতো এবং এখান থেকে কোনো শিক্ষার্থী বাইরে যেতো না। বর্তমানে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ না থাকার কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমস্যা হচ্ছে। এই স্কুল থেকে লেখাপড়া করে অনেকেই অফিসার হয়েছেন এবং জীবনে এগিয়ে গিয়েছেন। স্থানীয় সকলেই চায় বিদ্যালয়ে নতুন ভবন নির্মাণ হোক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হোক তাতেই আমরা খুশি।
বিদ্যালয়ের জমি দাতা নজরুল ইসলাম মাতুব্বর বলেন, তৎকালীন সময়ে কোনো স্কুল না থাকায় আমরা তিন ভাই সকলের অনুরোধে ৭৬ শতক জমি দান করি। তৎকালীন সময়ে প্রথম মামলা হলে আমরা রায় পেয়ে স্কুলের সকল কার্যক্রম শুরু হয়। স্কুল জাতীয়করণ হওয়ার পর ২০১৩ সালে আবার মামলা করে। জমির মামলায় চারটির মাঝে আমরা তিনটিতে রায় পাই। আমরা খোঁজ খবর না নেওয়ার কারণে ওরা একটি রায় পায়। বর্তমানে মামলার দোহাই দিয়ে কোনো কাজই ওরা করতে দিচ্ছে না। জমিদাতা তিন ভাইয়ের মধ্যে আমি একাই জীবিত আছি। মারা যাওয়ার আগে স্কুলটিতে একটি সুন্দর ভবন ও অবকাঠামো দেখতে চাই।
জমির মালিক দাবিদার মো. পান্নু ফকির বলেন, এই জমিটা আমাদের নামে রেকর্ড ভোগদখল দলিল করা। আমাদের জমি আমরা খাচ্ছি। এখানে কিছু ঘাতক বাহিনী আমাদের জমি জাল দলিল করে নিয়ে যেতে চাইছে। আমরা ভাঙ্গা দেওয়ানি আদালতে মামলা করে রায় পাইছি। এখন মামলা হাইকোর্টে চলছে। হাইকোর্ট যে নির্দেশ দেবে যে রায় দেবে সেটা আমরা মেনে নেবো। আমরা চাই এটার একটা সমাধান হোক। স্কুলের কার্যক্রম আমরা বাধা দিচ্ছি না, স্কুল চলছে চলুক। আমরা গরিব মানুষ। আমাদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়। আমরা গরিব মানুষ আমাদের এই জমিটা যেন আমরা পাই। যারা জমি স্কুলে দিয়েছে সেই জমি পাশেই আছে তারা সেই জমি বুঝিয়ে দিক।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. আতিকুর রহমান বলেন, অত্র বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন, এরপর আমি খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারি একটি পক্ষ গোয়ালঘর নির্মাণ করেছে এবং বিদ্যালয়ে অবকাঠামোর কোনো কাজই করতে দিচ্ছে না। বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহোদয়কে জানালে, তিনি বিদ্যালয়ের সভাপতি, প্রধান শিক্ষক ও জমি দাতার সাথে কথা বলেছেন। আশা করছি খুব দ্রত এই সমস্যার সমাধান হবে।
সালথা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আনিছুর রহমান বালী বলেন, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্তদের উচ্চ আদালতের আদেশ অনুসরণ করে দ্রুত গোয়ালঘর অপসারণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অন্যথায় আদালতের আদেশ অমান্য করার জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নয়া শতাব্দী/এসএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ