করতোয়া নদীর পাঁচ একর জমি দখল করে ইকোপার্ক গড়ে তুলেছে বগুড়ার বেসরকারি সংগঠন ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস)। এতে গতিপথ পরিবর্তনসহ নদীর একটি বড় অংশ তারা নিজেদের সীমানার মধ্যে নিয়ে নিয়েছে। ফলে ওই এলাকায় নদীর আকৃতি পরিণত হয়েছে নালায়। ড্রোন ক্যামেরা ও স্যাটেলাইট ইমেজের চিত্রে আগ্রাসী এ পরিবর্তনে খরস্রোতা করতোয়াকে মেরে ফেলার চিত্র একেবারে স্পষ্ট। দেশের প্রচলিত আইনে খাসজমি ইজারা দিলেও, নদী ইজারা দেয়ার কোনো বিধান নেই।
করতোয়া বাংলাদেশের অভিন্ন ৫৪ নদীর একটি। ঐতিহাসিক এ নদীর উৎপত্তি ভারতের হিমালয় পাদদেশে। আড়াই হাজার বছর আগের পুণ্ড্রনগরও গড়ে উঠেছে করতোয়ার কোলে। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোও বলছে, দখল ও দূষণকারীদের তালিকার মধ্যে টিএমএসএস অন্যতম। তাদের কাছে এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, নদীর গতিপথ পাল্টে দেয়া, বর্জ্য ফেলে ভরাট ও কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে নদীদূষণ, ড্রেজার বসিয়ে অবৈধ বালু উত্তোলনের তথ্য আছে। এ ছাড়া শহরে দখলদারদের তালিকাতেও রয়েছে টিএমএসএসের নাম। নবাববাড়ি মৌজায় তাদের পৌনে ১ শতক জমি রয়েছে।
তবে প্রশাসনের সাহায্যে দিনের পর দিন তাদের এ দখলদারিত্ব চলে আসছে। সরকারি নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, করতোয়া নদীর পাশে মহিষবাথান মৌজার খাস খতিয়ান দাগে মোট ১৬ দশমিক ৯৪ একর বদ্ধ জলাশয় বাংলা ১৩৯৭ থেকে ১৪০৫ সাল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০১৯ সালে একই মৌজার একই দাগে ৪০ দশমিক ৯১ একর উন্মুক্ত জলাশয় হিসেবে ১৩৯৮ সালের জন্য ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘের পক্ষে শামছুল হক নামে এক ব্যক্তিকে ইজারা প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে তৎকালীন বগুড়া জেলা প্রশাসক ১৯৯৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ১৬ দশমিক ৯৪ একর খাসজমি আদর্শ গ্রাম প্রকল্পের আওতায় গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসনের নিমিত্তে ৯৯ বছরের লিজ প্রদান করেন।
সে সময় টিএমএসএসের প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক ড. হোসনে আরা বেগম মহিষবাথান মৌজার ১৬ দশমিক ৯৪ একর ওই খাস সম্পত্তিতে স্বত্ব ঘোষণা, স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়া, অন্য কাউকে লিজ না দেয়ার প্রার্থনা করে বগুড়া যুগ্ম জেলা জজ প্রথম আদালতে একটি মামলা করেন। সেই মামলায় ২০০৯ সালের ৭ জুন তার পক্ষে আদালত রায় দেন। তারপর থেকেই টিএমএসএস বদ্ধ জলাশয়সহ নদীর একটি অংশে বালি এবং ময়লা-আবর্জনা দিয়ে ভরাট করে চলেছে। লিজ নেয়া ওই খাস জলাশয় পূরণ করে কিছু জায়গায় স্থায়ী বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছে।
গত মার্চে ‘মম ইন’ ইকোপার্কের পেছনে মাটি ও বর্জ্য ফেলে নদীর মূল প্রবাহ বন্ধ ও ভরাটের দায়ে টিএমএসএসকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় পাঁচটি ট্রাক জব্দ করা হয়। ঘটনার পর পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী হাসানুজ্জামান বাদী হয়ে টিএমএসএসের বিরুদ্ধে বগুড়া সদর থানায় একটি মামলা করেন। এর আগে ২০১৯ সালেও বগুড়া সদরের নওদাপাড়ার বারবাকপুর মৌজা পরিমাপ করা হয়।
সে সময় সওজ, ভূমি সার্ভেয়ার, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং টিএমএসএসের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ৬৪০৫ নম্বর দাগে সিএস নকশা অনুসারে নদীর একটি বড় অংশ দখল করার প্রমাণ মেলে। দখল করা স্থানে টিএমএসএসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘মম ইন’ ইকোপার্কের স্থায়ী অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়াও ২০১৯ সালে সরেজমিনে বগুড়ার করতোয়া, যমুনা ও বাঙালি নদী পরিদর্শন করেন নদী রক্ষা কমিশনের তৎপরতা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার। সেসময় জেলা প্রশাসকের কাছে দেয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নদীর জায়গা অবৈধভাবে দখলে নিয়ে টিএমএসএস ভবন বা স্থাপনা তৈরি অব্যাহত রেখেছে। তারা পার্কের ময়লা-আবর্জনা করতোয়ায় ডাম্পিং এবং নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলায় ভূগর্ভ ভেঙে তীর বসে যাচ্ছে। এ ছাড়া ‘মম ইন’ পার্ক নদীতে বাঁধ দিয়ে কৃত্রিম আইল্যান্ড তৈরি করেছে।
সরেজমিনে ইকোপার্কের পেছনের অংশে দেখা গেছে, সেখানে চার বছর আগে যে অংশটিকে কৃত্রিম আইল্যান্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তা এখন পার্কের ভিতরে চলে গেছে। নদী ঘিরে তৈরি করা হয়েছে জলাশয়। চারপাশে পিচঢালা পথ দিয়ে চলাচল করছে পার্কে আসা লোকজন। সেখানে নদীর দৃশ্য অবলোকন করার জন্য ওয়াচ রুম ও নৌভ্রমণের জন্য জেটি স্ট্যান্ড তৈরি করা হয়েছে। বিস্তৃত নদীর চার ভাগের তিন ভাগ বন্ধ করার কারণে সেখানে আকৃতি পেয়েছে সরু নালার।
টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক ড. হোসনে আরা বেগম বলেন, মূল নদীর কোনো জায়গা ‘মম ইন’ পার্কের ভিতরে নেয়া হয়নি। স্যাটেলাইটে এমন কোনো ইমেজ আসবে না। করতোয়া নদীর ওই অংশে বাইরের লোকেরা বালি তুলে নিচু করে ফেলেছে। গর্ত হওয়া জমিগুলো আমাদের অংশ। বালি উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে ১৪টি মামলা করেছি।
হোসনে আরার দাবি, নদীর দুই তীরের ৫ কিলোমিটার এলাকায় তাদের প্রতিষ্ঠানের ১০২ একর জমি রয়েছে। নদীভাঙনে তাদের ৪০ একর জমি বিলীন হয়েছে। এখন তাদের কোনো স্থাপনা নদী দখল করে করা হয়নি। আর জেলা প্রশাসনের দখলকারী তালিকা প্রসঙ্গে বলেন, এটি বিভ্রান্তিকর। এ তালিকা থেকে নাম অপসারণ করতে আমরা আবেদন জানিয়েছি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) রাজশাহী ও রংপুর বিভাগীয় সমন্বয়কারী তন্ময় কুমার সান্যাল বলেন, বগুড়ায় জেলা প্রশাসনের তৈরি করা দখলকারীদের দুই তালিকাতেই টিএমএসএসের নাম রয়েছে। এ ছাড়া গোকুলে মেরিন একাডেমি তৈরির নামেও তারা নদীকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। বিভিন্ন সময় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর চেষ্টা করলেও লাভ হয়নি। নদী দখলের ক্ষেত্রে তাদের খুঁটির জোর কোথায়, সেই বিষয়টিও রহস্যজনক।
সীমানা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে ওই স্থানে মূল প্রবাহই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। টিএমএসএস ৯৯ বছরের জন্য নদীর জমি ইজারা নেয়ার কথা জানায়। কিন্তু সরকার কীভাবে এই জমি ইজারা দিয়েছে, সেটি বোধগম্য নয়। বগুড়ার বর্তমান জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, নদী দখল-দূষণের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স অবস্থানে আছি। ওই স্থানে ফের পরিমাপ করা হবে। যদি প্রমাণ হয় নদীর জায়গা টিএমএসএসের দখলে রয়েছে, তাহলে অবৈধভাবে নদী দখল-দূষণে তাদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নয়াশতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ