ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দুধের রাজধানী জেয়ালা গ্রাম

প্রকাশনার সময়: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৫:০৬

গরুর দুধ কে না পছন্দ করেন। মানুষের খাদ্যতালিকায় দুধ হলো অন্যতম প্রধান খাবার। সর্বোচ্চ পুষ্টিমানের জন্যই দুধ শ্রেষ্ঠ। আর সে দুধ যদি খুব সহজেই হাতের নাগালে পাওয়া যায় তাহলে কতই না স্বস্তির। এই দুধের কারণে তালা উপজেলাকে বলা হয় দুধের রাজধানী।

সাতক্ষীরার তালা সদরের জেয়ালা গ্রামে ঘোষ সম্প্রদায়ের বসতি। এক সময়ের অবহেলিত ঘোষপাড়া জনপদটি এখন দুধপল্লি নামে পরিচিত। দুধ উৎপাদনের জন্য জাতীয়ভাবে পরপর চারবার পেয়েছে শ্রেষ্ঠ সমবায়ী পুরস্কার।

প্রতিদিন ৫০-৬০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয় এই পল্লিতে। এই দুধ রফতানি হয় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে, যা প্রভাব ফেলেছে এলাকার অর্থনীতিতেও। যার ফলে যুবকরাও এখন ঝুঁকছেন গাভী পালনে, গড়ে তুলছেন খামার।

তালার আটারই গ্রামের আবু হারেজ সরদারের ছেলে আল-আমিন সরদার দুটি গাভী নিয়ে খামার শুরু করেন ২০১০ সালে। এখন আল-আমিনের খামারে ৩০টি গাভী। দৈনিক খরচ বাদ দিয়েও দুধ বিক্রি করে আয় করছেন ১২-১৫শ’ টাকা।

খামারি আল-আমিন সরদার জানান, এক সময় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। একটি গাভী ৫৫ হাজার ও আরেকটি ৮৫ হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করে শুরু করি খামার। এখন আমার খামারে রয়েছে ৩০টি গাভী। এর মধ্যে ১০টি গাভী দৈনিক একশ’ লিটার দুধ দেয়। প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হয় ৩৫ টাকায়। আমার খামার থেকে দৈনিক ৩৫শ’ টাকার দুধ বিক্রি হচ্ছে। বাকি গাভীগুলোও পর্যায়ক্রমে দুধ দেবে। বর্তমানে ৩৫শ’ টাকার দুধ বিক্রি করে গাভীর পেছনে খরচ বাদ দিয়ে ১০০০-১২০০ টাকা লাভ হচ্ছে। অভাব কাটিয়ে আমি এখন স্বাবলম্বী।

এছাড়া জেয়ালা গ্রামের ঘোষপাড়া ঘুরে দেখা যায়, এই গ্রামে ২২৬ ঘর ঘোষ বসবাস করে। আর গরু পালন করে ২ হাজার ৬২০টি। এমন কোনো বাড়ি নেই যে সেখানে ২-৬ গাভী নেই। এরই জন্য উপজেলা সদরসহ জেয়ালা গ্রামের আশপাশে গড়ে উঠেছে দুগ্ধ সংশোধনী কেন্দ্র। পাখিডাকা ভোরেই জেগে ওঠে জেয়ালা। নারী-পুরুষ ছোটেন গোয়ালঘরের দিকে। শুরু করেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ। গোবর সরিয়ে রাখেন নির্দিষ্ট স্থানে। পাইপের পানি দিয়ে গা ধোয়ানো হয় গাভীগুলোর। খেতে দেয়া হয় ঘাস-বিচালি কিংবা ভুষি, খইল অথবা অন্য কিছু। দুধ দুইয়ে রাখা হয় ছোট-বড় সিলভারের কলসি কিংবা প্লাস্টিকের পাত্রে। তার পর এসব দুধভর্তি পাত্র নিয়ে সাইকেলে পুরুষরা ছোটেন তা বিক্রি করতে। চলে আসে দুধ সংশোধনী কেন্দ্রে।

জেয়ালা গ্রামের দুধ ব্যবসায়ীরা বলেন, এটা আমাদের পৈতৃক ব্যবসা। তবে আগে স্বল্প পরিসরে থাকলেও বর্তমানে খামারটি বড় আকারে করেছি। প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হয় সাড়ে ৩৭ টাকা। এছাড়া দৈনিক খরচ হয় ৬-৭ হাজার টাকা। প্রতিদিন খরচ বাদ দিয়েও ৫ হাজার টাকার বেশি লাভ হয়।

জেয়ালা গ্রামের চারবার জাতীয় ও উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে অসংখ্যবার পুরস্কারপ্রাপ্ত দিবস চন্দ্র ঘোষ বলেন, ১৯৯৪ সালে ১টি বিদেশি গরু ক্রয় করেন। বর্তমানে তার খামারে ৫৫-৬০টি বিদেশি গরু আছে। নিজেই দুগ্ধ দোহন করেন। গাভী পালনের জন্য কাজের লোক থাকলেও, গাভীর দুধ দোহনে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। নিজের কাজ নিয়ে করতে ভালোবাসেন, এখনো তিনি সকালে ও বিকেলে ২৫ থেকে ৩০টি গাভীর দুধ দোহন করেন। প্রতিটি গাভী হতে ১০ হতে ২০ কেজি পর্যন্ত দুধ পাওয়া যায় বলে তিনি জানান। এ সকল কাজের স্বীকৃতির পুরস্কার হিসেবে ২০০৭ সালে জাতীয় পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার। জাতীয় পর্যায়ে ২০০৯ সালে শ্রেষ্ঠ দুগ্ধ সমবায় সমিতির পুরস্কার, ২০১১ সালে জাতীয় পর্যায়ে ব্যক্তিগত সমবায়ী হিসেবে পুরস্কার এবং বর্তমানে ২০২০ সালেও তিনি জাতীয় পর্যায়ে সমবায় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এই নিয়ে তিনি চতুর্থবারের মতো জাতীয় পুরস্কার পেলেন। এ ছাড়া উপজেলা পর্যায়ে তিনি টানা ১০ বৎসর শ্রেষ্ঠ সমবায় সমিতির পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি ২০০৬ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একটানা জেয়ালা ঘোষপাড়ার সমবায়ী দুগ্ধ উৎপাদন ও তালা কেন্দ্র দুগ্ধ সমিতির সভাপতি ছিলেন, আইনের জটিলতার জন্য দুই বছর পরে ২০১৮ সাল থেকে অদ্যাবধি আবারো সভাপতি নির্বাচিত হয়ে আছেন। তিনি ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ মিল্ক ভিটার পরিচালক ছিলেন। তিনি সমবায়ী হিসেবে ২০০৬ সালে সমিতির নিবন্ধন লাভ করেন। তিনি ৩ সন্তানের পিতা। এক মেয়ে ও দুই ছেলে। বড় ছেলে বিদুর চন্দ্র ঘোষ ঢাকা মিল্ক ভিটার অডিটর হিসেবে কর্মরত আছেন। ছোট ছেলে বিক্রম কুমার ঘোষ হিসাববিজ্ঞানের ওপর অনার্স করেছেন। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি অনেক সুখে জীবনযাপন করছেন। সাতক্ষীরা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বলেন, সাতক্ষীরা জেলা দুধে সমৃদ্ধ। জেলায় প্রতি বছর এক দশমিক ৯০ লাখ টন দুধ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন হয় তালা উপজেলায়। চাহিদার চেয়ে বেশি দুধ উৎপাদন হওয়ায় এই দুধ রফতানি হয় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। প্রাণ, ডেইরি মিল্ক, আড়ং, মিল্ক ভিটা এসব দুধ খামারিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দুগ্ধ জাতীয় পণ্য প্রস্তুত করে।

তিনি আরো বলেন, জেলায় খামারির সংখ্যা রয়েছে দুই হাজার ৫০২ জন। ছোট-বড় খামার রয়েছে আড়াই হাজার। খামারিদের প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়া ও চিকিৎসা-সংক্রান্ত সহায়তা করা হয়। এছাড়া তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গাভী পালনে সহযোগিতা পরামর্শ দেয়া হয়। গত ১২ ডিসেম্বর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট নামে একটি মেগা প্রকল্প চালু হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে খামারিরা রেজিস্ট্রেশন করছেন। রেজিস্ট্রেশন করার পর খামারিরা তাদের ইচ্ছামতো দুধ বিক্রি করতে পারবেন। আমরা তাদের ইচ্ছে অনুসারে দুধ মার্কেটিং ও উৎপাদনে সহযোগিতা করব। এছাড়াও সরকারিভাবে আর্থিকসহ আনুষঙ্গিক সহযোগিতাও পাচ্ছে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ