ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

যে যার মতো চলছে রামু সরকারি কলেজে

প্রকাশনার সময়: ১৯ নভেম্বর ২০২৩, ১৩:৩৮

নানা অনিয়ম-দুর্নীতি প্রকাশ্যে চলে আসায় নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন অধ্যক্ষ। যে কারণে এখন কেউ কারও কথা শুনছে না। এইচএসসি, ডিগ্রি, অনার্স পর্যায়ে কোনো শিক্ষকই ঠিকমতো ক্লাস নিচ্ছেন না। বেশির ভাগ শিক্ষক কলেজে গিয়ে স্বাক্ষর করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করছেন। আবার অনেক শিক্ষক ভুয়া প্রকল্পের বিল ভাউচারে সই দেওয়ার ভয়ে অধ্যক্ষকে এড়িয়ে চলছেন। এভাবেই চলছে কক্সবাজারের রামু সরকারি কলেজের কার্যক্রম।

জানা গেছে, অধ্যক্ষ মুজিবুল আলমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও উন্নয়ন প্রকল্পের নামে কোটি টাকা আত্মসাৎ, নিজের শিক্ষককে নাম ধরে ডাকা, শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এসব নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশ হয়েছে।

এত কিছুর পরও তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ায় কলেজটিতে একাডেমিক ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে প্রথম বর্ষের সমাপনী পরীক্ষা শেষ হওয়ার একমাস হলেও এখনো ফল প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি, যা কলেজের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এভাবে চলতে থাকলে কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমে ধস নামবে বলে শঙ্কিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক জানান, ৯ অক্টোবর শুরু হওয়া প্রথমবর্ষের সমাপনী পরীক্ষা শেষ হয় ১৭ অক্টোবর। একমাস হলেও ফল প্রকাশ করা যায়নি, যা কলেজের ইতিহাসে নজিরবিহীন।

কলেজের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে জানিয়ে এই শিক্ষক বলেন, এখন অধ্যক্ষের কথা কেউ শোনে না। অধ্যক্ষ এখন নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত। শিক্ষকদের ম্যানেজ করা এবং বিল ভাউচার তৈরিতে সময় দিচ্ছেন তিনি। অন্যদিকে ক্লাস হচ্ছে কি হচ্ছে না, সেদিকে দেখার সময় অধ্যক্ষের নেই।

ফল প্রকাশের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথমবর্ষ সমাপনী পরীক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ও কলেজের সহকারী অধ্যাপক ছলিম উল্লাহ বলেন, একটি বিষয়ের খাতা মূল্যায়ন ও ব্যবহারিক পরীক্ষা শেষ না হওয়ায় ফলাফল প্রস্তুত করা যায়নি।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা আতঙ্কে-

বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও অনুষ্ঠানের নামে কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা অনেকেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এখন তারা বিল ভাউচারে স্বাক্ষর দিতে ভয় পাচ্ছেন। অনেকে এ ভয়ে অধ্যক্ষকে এড়িয়ে চলছেন। আবার কিছু শিক্ষককে অধ্যক্ষ এবং তার অনুসারীরা বিল ভাউচারে সই দিতে চাপ দিলেও অনেকে তা শুনছেন না।

কলেজের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক প্রধীর রঞ্জন দাশ গুপ্ত বলেন, আমাকে প্রকল্পের আহ্বায়ক করা হয়েছে, যা আমি জানতামও না। আমার নামে চেকও ইস্যু করা হয়েছে। কিন্তু আমি একটা চেকের টাকাও ব্যাংক থেকে উত্তোলন করিনি। কাজও করিনি। কিন্তু এখন আমাকে বিল ভাউচারে স্বাক্ষর দিতে বলা হলেও আমি অনীহা প্রকাশ করি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, ১৫-২০টি গণমাধ্যমে অধ্যক্ষের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ ছাপা হয়েছে। আমরা সাধারণ শিক্ষকরা লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না। কিন্তু তিনি বদলি ঠেকানোর জন্য একবার মন্ত্রণালয়, একবার মাউশিতে (মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর) দৌড়ঝাঁপ নিয়ে ব্যস্ত। এসব ছাড়াও আগামী সপ্তাহে তদন্ত বা অডিট টিম আসবে, তাদেরও নাকি ম্যানেজ করে ফেলেছেন অধ্যক্ষ এমন কথাও সবার মুখে মুখে।

এদিকে এতসব অভিযোগের পরও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ায় কলেজের এমন বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান রামু কলেজ প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী পরিষদের সহ-সভাপতি ও কলেজের দাতা পরিবারের সদস্য নুরুল কবির।

তিনি বলেন, অধ্যক্ষের অনিয়ম-দুর্নীতির খবর প্রকাশ্যে চলে আসায় বর্তমানে কলেজটির একাডেমিক ও প্রশাসনিক চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে। আমরা চাই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার মধ্য দিয়ে কলেজে শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসুক। কিন্তু এত গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পরও এখনো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙেনি, বিষয়টি দুঃখজনক।

বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত খবর অনুসারে, বার্ষিক সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, এইচএসসি শিক্ষার্থীদের বিদায় এবং বৃক্ষরোপণ, শিক্ষক পার্কিং শেড নির্মাণ, পার্কিং শেড রংকরণ, পার্কিং শেডে গ্রিল লাগানো, মাটি ভরাট, চাল মেরামত, ক্রোকারিজ সামগ্রী ক্রয়সহ অন্তত অর্ধশতাধিক অনুষ্ঠান ও উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অধ্যক্ষ হাতিয়ে নিয়েছেন অন্তত কোটি টাকা। এক্ষেত্রে নিজের পছন্দের গুটি কয়েক শিক্ষকের নাম ব্যবহার করেছেন তিনি।

একাধিক জাতীয় এবং স্থানীয় গনমাধ্যমে “ভুয়া প্রকল্প-বিনা রশিদে ‘অধ্যক্ষের পকেটে’ কোটি টাকা”, ‘অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ’, ‘৫ বছর পরে এলো রামু কলেজে সরকারি নিয়মে বেতন-ফি আদায়ের ঘোষণা’, ‘নারী শিক্ষককে মারতে তেড়ে গেলেন প্রভাষক’, ’১৫ আগস্টের অনুষ্ঠান ব্যয় থেকে দেড় লাখ টাকা ফেরত দিলেন অধ্যক্ষ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করা হয়।

এছাড়াও বিভিন্ন গণমাধ্যমে দফায় দফায় সংবাদ ছাপা হলে ‘১৫ আগস্ট/ জাতীয় শোক দিবস’ শীর্ষক অনুষ্ঠান উদযাপনের প্রায় দুইমাস পর এই খাত থেকে দেড় লাখ টাকা ব্যাংকে ফেরত পাঠানো হয়। একইভাবে কলেজের জমির লাগিয়ত বাবদ ব্যাংকে জমা করা হয় ২৯ হাজার টাকা।

এসব অভিযোগের বিষয়ে রামু সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মুজিবুল আলমের বক্তব্য নেওয়ার জন্য মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

তবে অধ্যক্ষের অনিয়ম তদন্তে কমিটি গঠনের কথা জানিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক প্রফেসর অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর বলেন, অভিযোগের ভিত্তিতেই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সবগুলোই খতিয়ে দেখা হবে।

তদন্ত নিরপেক্ষ হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমি আমার অফিসারদের সব সময় বলি কোনোভাবেই ম্যানেজ হওয়া যাবে না। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আমরা প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেব, সেখান থেকে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে মন্ত্রণালয় যদি মনে করে আরও গভীর তদন্ত হওয়া দরকার, তাহলে তাও করতে পারে।

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ