ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

অস্তিত্ব হারাচ্ছে চলনবিলের নদ-নদী

প্রকাশনার সময়: ১৮ অক্টোবর ২০২৩, ১৬:৫৫ | আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২৩, ১৬:৫৯

পদ্মায় জন্ম আর যমুনায় বিলীন। নদীটির নাম প্রমত্তা বড়াল। ২২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই নদীর পেট চিরে জন্মেছে নদী-নালা, খাল-বিল। পদ্মা ও যমুনার পানি এই নদী হয়েই গড়িয়ে পড়তো দেশের সর্ববৃহৎ চলনবিলে। অথচ ৫০০ ফুটপ্রস্থের নদীটির উৎসমুখে ১৯৮৪ সালে নির্মিত হয়েছে তিন কপাটের একটি স্লুইসগেট। সেই থেকে বড়াল তার যৌবন হারিয়েছে।

শুধু বড়াল নয়; যৌবন হারিয়েছে নন্দকুঁজা, নারদ, চিকনাই, রূপনাইয়ের মতো চারটি বড় নদীও। একইসঙ্গে চলনবিলের বুক চিরে বয়ে যাওয়া ৪০টির মতো নদী, প্রায় ২০০টি নালা এবং অন্তত ২৫০টি বিল মৃতপ্রায় হয়ে গেছে। ১৯৮৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে মিলিয়ে গেছে মির্জামামুদ, তুলশীগঙ্গার মতো বেশকিছু নদীর চিহ্ন।

বড়ালপাড়ের বাসিন্দা ও ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, রাজশাহীর চারঘাট থেকে উৎপত্তি হয়ে চলনবিলের বুক চিরে বয়ে চলা বড়াল নদীটি মুশাখাঁ, আত্রাই, গুমানি, নন্দকুঁজা, চিকনাইসহ বেশ কয়েকটি নদীর জন্ম দিয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ির হুড়সাগর হয়ে যমুনায় মিলিত হয়েছে।

চলনবিল রক্ষা ও বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব মিজানুর রহমান জানান, দেশের বৃহত্তম পদ্মা, যমুনা নদী এবং বিশাল জলাভূমির চলনবিলের মধ্যে প্রধান সংযোগ নদী বড়াল। এই নদী ৪টি জেলা ও ৮টি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। আশির দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ড অপরিকল্পিতভাবে নদীর উৎসমুখ ও ৪৬ কিলোমিটার ভাটি এলাকার আটঘরিতে স্লুইসগেট নির্মাণ করার পর থেকেই মরতে বসে বড়ালের পানি খেয়ে তৃষ্ণা মেটানো চলনবিল এলাকা ও নদী-নালা।

জানা গেছে, উল্লেখযোগ্য কোনো কারণ ছাড়াই ১৯৮৪ সালে রাজশাহীর চারঘাট এলাকায় প্রায় সাড়ে ৫০০ ফুট প্রস্থের বড়ালের উৎসমুখে মাটির বাঁধ দিয়ে বন্ধ করা হয় নদীটির প্রবাহ। সেসময় ওই বাঁধের কারণে উত্তাল পদ্মার পানি আর বড়ালে গড়ায়নি। এতে খরায় পরে ভাটি অঞ্চলের চলনবিল ছাড়াও ৪ জেলা ও ৮ উপজেলার নদী-নালা। ভাটি এলাকার মানুষের দাবির মুখে সাড়ে ৫শ ফুট প্রস্থের ২১ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহের বড়ালের উৎসমুখে ৫ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহের ৩০ ফুটপ্রস্থের জলকপাট নির্মাণ করা হয়। এরপর থেকে নিয়ন্ত্রিত পানি প্রবাহের ফলে খরস্রোতা বড়াল তার জৌলুশ হারায়।

২২০ কিলোমিটার নদীর মধ্যে ৪০ বছরে বড়ালের ১২০ কিলোমিটার বেদখল হয়ে যায়। শুধু বড়ালের পানি প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় চলনবিলের নদী ও খালের মধ্যে আত্রাই, নন্দকুঁজা, গুমানী, গুড়, করতোয়া, বড়াল, তুলসি চেঁচিয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, নবীরহাজির জোলা, হকসাহেবের খাল, নিমাইচড়াখাল, বেশানীরখাল, গুমানীখাল, উলিপুরখাল, সাঙ্গুয়াখাল, দোবিলাখাল, কিশোরখালির খাল, বেহুলারখাড়ি, বাকইখাড়া, গোহালখাড়া, গাড়াবাড়ি খাল, কুমারভাঙ্গাখাল, জানিগাছার জোলা, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধরসহ অসংখ্য নদী-নাল খাল তিন দশকের বেশি সময় ধরে খরায় পুড়ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সাল থেকে বড়াল ও চলনবিলের নদ-নদী রক্ষায় আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংকে (আইডব্লিউএম) বড়াল নদীর পানি সম্পদ পুনরুদ্ধারে সমীক্ষা প্রকল্প শুরু হয়। ওই সমীক্ষার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বড়ালের উৎসমুখে চারঘাট এলাকায় দেওয়া সরু স্লুইসগেট অপসারণ করে সেখানে ব্রিজ নির্মাণ এবং ব্যাহত হওয়া ১২০ কিলোমিটার দখলমুক্ত করাসহ ২২০ কিলোমিটার নদী খননের কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড চারঘাটের স্লুইসগেট বহাল রেখে প্রকল্পটিকে দুইভাবে বিভক্ত করে বাস্তবায়ন করতে চাইছে। এতে শুধু দীর্ঘসূত্রতাই বাড়বে। কাজের কাজ কিছুই হবে না।

নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, বছর খানেক আগে ‘বড়াল নদীর অববাহিকায় পানি সম্পদ পুনরুদ্ধার’ নামে একটি প্রকল্প জমা দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়ে ২ হাজার ৫২ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় বড়াল নদীর ১০৪ কিলোমিটার, নারোদ নদীর ৪৩ কিলোমিটার এবং মুসাখাঁ নদীর ৬ কিলোমিটার খননের কথা বলা হয়েছে।

নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী জানান, বড়ালের উৎসমুখে নির্মিত স্লুইসগেটটি বর্তমানে কোনো কাজে আসছে না। তবে এটি তৎকালীন সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিল বন্যা নিয়ন্ত্রণের কারণে।

ইম্পেরিয়েল গেজেট অব ইন্ডিয়া বই থেকে জানা যায়, চলনবিল অঞ্চলে ১৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, ৪২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাল রয়েছে। এরমধ্যে প্রধান নদী ৯টি, ২০টি খালসহ ছোট ছোট বিভিন্ন বিল ও খাল রয়েছে। অতীতে ২৩ হাজারের মতো বড় বড় পানির জলাধর ছিল। যা বেশিরভাগই বেদখলকৃত ও হাত ছাড়া হয়ে গেছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. মো. রেদওয়ানুর রহমানের প্রবন্ধ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, প্রায় ৩০ বছর আগেও চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এসব নদ-নদীতে বছর জুড়েই ৬-১২ ফুট পানি থাকতো। ফলে বছর জুড়েই নৌ চলাচল করতো। কিন্তু পানির প্রবাহ না থাকায় বছরের পর বছর পলি জমে এসব নদী ভরাট হয়ে গেছে।

পরিসংখ্যান মতে, প্রতি বছর ২২২১ / ২ মিলিয়ন ঘনফুট পলি প্রবেশ করে এবং ৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট পলি বর্ষায় চলনবিলে জমে। ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে-জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ফারাক্কার বাঁধ বিরূপ প্রভাব ও আশির দশকে পদ্মার উৎস মুখে অপরিকল্পিত স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে চলনবিলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত বিভিন্ন নদ-নদী ও বিল, জলাশয়, খালগুলোতে পলি জমে ক্রমশ ভারাট হয়ে গেছে। তাছাড়া বিলের মাঝ দিয়ে যথেচ্ছাভাবে সড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট, নদী দখল করে বসতি, দোকান পাট স্থাপন করায় নদীগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের চলনবিল মৎস্য প্রকল্প থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮২ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে এক সমীক্ষায় দেখা যায় ১৯৮২ সালে মোট ১,৭৭,০৬১ জেলে এসব নদ-নদী ও খাল জলাশয়ে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো। পর্যায়ক্রমে কমতে কমতে ২০০৬ সালে এর সংখ্যা ৭৫,০০০ জনে দাঁড়িয়েছে।

নয়া শতাব্দী/এসএ/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ