উদ্যোক্তা বাবুল আখতারের সফলতার গল্পটা শুরু হয় ২০০৭ সালে। একজন ডাক্তাররের কাছ থেকে তিনি জানতে পরেন মাশরুম চাষ করে অসহায় ও প্রতিবন্ধী যুবকেরা স্বাবলম্বী হতে পারে। এরপর যশোরে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। সেখানে মাশরুম চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রশিক্ষণ থেকে পাওয়া ৫ শত টাকা ও ১শত মাশরুমের বীজ দিয়ে যাত্রা শুরু হয় তার। পরের বছর ২০০৮ সালে ঢাকার সাভার থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রশিক্ষণ নিয়ে নতুন ভাবে এ চাষে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তার। প্রথম দিকে শুধু মাশরুম চাষ করে তা বিক্রি করতেন তিনি। পরবর্তীতে মাশরুমের বীজ উৎপাদনে সক্ষম হন বাবুল। এরপর মাশরুম চাষে এলাকার কৃষকদের সম্পৃক্ত করেন। এ কাজে তিনি এলাকার প্রায় ১ হাজার মানুষকে মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে মাশরুম চাষে সক্ষম ও সফল করে তোলেন। এলাকায় গড়ে তোলেন মাশরুম খামার।
প্রতিবন্ধী বাবুল আখতারের বসত ভিটা আর কিছুই ছিল না। সারাক্ষণ শুধু ভাবতেন কী করবেন। শারীরিক প্রতিবন্ধী হবার কারণে তার দ্বারা শক্ত কোন কাজ করাও সম্ভব ছিলো না। শত প্রতিকূলতার মধ্যে প্রাথমিক পেরিয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি আর পেরুতে পারেননি তিনি। কিন্তু জীবন তো আর থেমে থাকার নয়। পরবর্তীতে একজন ডাক্তারের পরামর্শে মাশরুম চাষে আগ্রহী হন তিনি। শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও অদম্য উৎসাহ ও ইচ্ছা শক্তির দ্বারা কেবলমাত্র মাশরুম চাষ করেই শূন্য থেকে কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয় অতিসম্প্রতি ওষুধ প্রশাসন থেকে ৮০ প্রকারের ওষুধ তৈরির অনুমোদনও পেয়েছে তারই হাতে গড়া ড্রিম মাশরুম সেন্টার।
এমনই একজন যুবক উদ্যোক্তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে, যার সফলতার গল্প যেন কোন কল্প কাহিনীকেও হার মানাবে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই গল্পের সফল নায়ক মাগুরার সদর উপজেলার ৭ নং মঘী ইউনিয়নের বড়খড়ী গ্রামের মো. বাবুল আখতার। এ কাজে সফলতার জন্য ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে জাতীয় যুব ও জাতীয় কৃষি পদক পান তিনি । বর্তমানে তিন একর জায়গার ওপর গড়ে তুলেছেন ড্রিম মাশরুম সেন্টার নামে একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান।
বর্তমানে সারা দেশে ৬৪টি শো-রুম এবং ১ হাজার মার্কেটিং প্রমোশন অফিসার কাজ করছেন তার অধীনে। এই কর্মী বাহিনীর মাধ্যমে দেশ ব্যাপী মাশরুম বিপননের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। পাশের দেশ ভারতেও তার উৎপাদিত এবং প্রক্রিয়াজাতকৃত মাশরুম রপ্তানি করা হচ্ছে।
বাবুল আখতারের ড্রিম মাশরুম সেন্টারের ফ্লোরে থরে থরে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাশরুম । ল্যাব ও কারখানায় কাজ করছেন একদল কর্মী। সেখানে নির্দেশনা দিচ্ছেন তিনি। বর্তমান বিশ্বের সবথেকে মূল্যবান মাশরুম রয়েছে তার এখানে, যা ক্যান্সার ও ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য কার্যকরী।
বাবুল আখতার নয়া শতাব্দীকে জানান, “শিল্প উদ্যোক্তার প্রশিক্ষণের পর তিনি ব্যাপকভাবে গ্রামে খামারি তৈরি করার কাজে হাত দেন। ২০১২-’১৩ সালে তার খামারে ব্যাপকভাবে ওয়েসটার মাশরুমের চাষ শুরু করেন। এরপর নিজ গ্রামে খামার বৃদ্ধি করে সেখানে মাশরুম ভিলেজ সৃষ্টি করেন। এ কাজে এলাকার কৃষকদের সম্পৃক্ত করেন তিনি। এরপর ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে তিনি উৎপাদিত মাশরুম বিপননের জন্য তিন শতাধিক কর্মী নিয়োগ করেন। ২০১৭ সালে তিনি বিশ্বের ১ নাম্বার গ্যানো ডারমা মাশরুম পরীক্ষামূলক ভাবে উৎপাদন শুরু করেন। এরপর তা দেশব্যাপী প্রসারের জন্য কর্মতৎপরতা শুরু করেন। এর ধারাবাহিকতায় তিনি ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে জাতীয় যুব পদক এবং জাতীয় কৃষি পদক পান।”
হাসিভরা মুখে বাবুল আখতার বলেন, একদিন দুশ্চিন্তা করতাম, আমার ভবিষ্যৎ কী হবে। কিন্তু আজ এখানে প্রায় কোটি টাকার প্রজেক্ট দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছি। শুধুমাত্র সেন্টারটি সেট-আপ করতেই প্রায় ১৮ কোটি টাকার মতো ব্যয় হয়েছে বলে তিনি জানান। তিন আরো বলেন, ভারতের মার্কেটে আমি প্রডাক্ট পাঠাচ্ছি। এখন আমার টার্গেট ইউরোপের মার্কেট ধরা।
বাবুল আখতারের ড্রিম মাশরুম সেন্টারের ল্যাব টেকনিশিয়ান লিপি দাস বলেন, আমি চার বছর ধরে এখানে চাকরি করছি। বর্তমানে এখানে অনেক প্রডাক্ট তৈরি করা হচ্ছে, যেগুলো বাইরের দেশে পাঠানো হচ্ছে।
এখানকার ন্যাশনাল সেলস ম্যানেজার মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এর আগে আমি হামদর্দ ল্যাবরেটরীজে কাজ করেছি। তবে বাবুল আখতার সাহেবের কর্মকান্ড দেখে আমি মুগ্ধ। সে কারণেই এখানেই কর্মরত আছি।
প্রতিবেশী সবিতা রাণী বলেন, বাবুল আক্তারের হাত ধরেই আজ আমাদের মতো অনেক লোক আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছি।
কৃষি বিভাগ মাগুরা অঞ্চরের উপ-পরিচালক সুশান্ত কুমার প্রামাণিক বলেন, উৎসাহ, উদ্দীপনা, প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে কীভাবে সফলতা অর্জন করা যায়, তার মডেল হচ্ছেন বড়খড়ী গ্রামের বাবুল আখতার। তিনি বর্তমান সমাজে বেকার যুবকদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত বলে আমি মনে করি।
এ বিষয়ে মাগুরার জেলা প্রশাসক ডাঃ আশরাফুল আলম নয়া শতাব্দীকে বলেন, “বাবুল আখতার মাশরুম চাষ করে বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন। তাছাড়া, তিনি অনেক উদ্যোক্তা তৈরি করে যাচ্ছেন। আমি তার এই অভাবনীয় কাজের প্রশংসা করি।”
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ