মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল বাকী হত্যা এবং জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কুষ্টিয়ার কাজী আরিফ আহম্মেদসহ ৫ জনকে হত্যা মামলার ফাঁসির আসামি রওশন আলীকে আদালতে হাজির করেছে পুলিশ।
সোমবার (৬সেপ্টেম্বর) বেলা ১১ টার দিকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে রওশনকে মেহেরপুর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক রিপতি কুমার বিশ্বাসের আদালতে তোলা হয়। বেলা সোয়া ১১ টার দিকে বিচারক রিপতি কুমার বিশ্বাস রওশনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করার নির্দেশ দেন।
২২ বছর আত্মগাপেনে থাকার পর র্যাবের হাতে রাজশাহী থেকে আটক হন রওশন। আত্মগোপনে থেকে রওশন নাম পাল্টে উদয় মন্ডল নামে ২২ বছর ধরে রাজশাহী এলাকার একটি গ্রামে বসবসা করে আসছিলেন। জাতীয় পরিচয় পত্রে তিনি উদয় মন্ডল নাম ব্যবহার করে আসছিলেন।
র্যাব সূত্র জানায়, দীর্ঘ সময় ধরে নাম পরিবর্তন ও দাঁড়ি রেখে রাজশাহী এলাকায় বসবাস করছিল রওশন। র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারীতে তাকে আটক করা হয়েছে। জাসদের প্রতিষ্ঠাতা ও কুষ্টিয়ার কাজী আরিফ আহম্মেদসহ জাসদের পাঁচ নেতা এবং মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার কাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান পীরতলা গ্রামের আব্দুল বাকী হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি রওশন আলী।
এছাড়াও একই এলাকার ভবানীপুর গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ হোসেন মাস্টার এবং আলম হুজুর হত্যা মামলার আসামি রওশন আলী।
জানা গেছে, এক সময় মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার ভবানীপুর, পীরতলা, কাজীপুর, আড়পাড়া, শানঘাট, চান্দামারী এবং কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার কিছু এলাকায় চরমপন্থী সংগঠনের আনাগোনা ছিল। মেতে উঠেছিল হত্যাযজ্ঞে, ওই সময় কাজীপুর এলাকায় প্রভাবশালী কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে গ্রুপিং শুরু হয়। তখন কাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন আব্দুল বাকী। ওই পরিষদের মেম্বর ছিলেন কাজীপুর গ্রামের নুরু মেলেটারি।
প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নুরু মেলেটারি এলাকার যুবক রওশনকে হাত করেন। দ্বন্দের জের ধরে ১৯৯৯ সালের ১৩ এপ্রিল প্রকাশ্য দিবালোকে আব্দুল বাকী চেয়ারম্যানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের সময় রওশন মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন। নুরু মিলিটারি ছিলেন পেছনে বসা। কুষ্টিয়া-মেহেপুর সড়কের গাংনীর তেরাইল কলেজের পাশে মোটর সাইকেলে উপরে বসেই বাকী চেয়ারম্যানকে গুলি করে হত্যা করে তারা পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় বাকীর ভাই সাজ্জাদুল স্বপন বাদি হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার আসামি হিসাবে রওশন আলীকে ২০১৭ ইং সালের ২৭ এপ্রিল মেহেরপুর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিজ্ঞ বিচারক টি এম মুসা তাকে ফাঁসির আদেশ দেন। এদিকে আব্দুল বাকীকে হত্যাকাণ্ডের পর বেপরোয় হয়ে ওঠে নুরু মিলিটারি ও রওশন আলী। বাকী হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তোলেন আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ মাস্টার। বাকী হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস পর প্রকাশ্য দিবালোকে ভবানীপুর-পীরতলা মাঠের সড়কে গুলি করে আমাজাদ মাস্টারকে হত্যা করেন তারা। হত্যা মামলাটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
এর আগে আমজাদ মাস্টার ও আব্দুল বাকীর ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত ভবানীপুর গ্রামের আলম হুজুরকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছিল রওশন ও তার বাহিনীর সদস্যরা। এদিকে আমজাদ মাস্টার হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই এলাকায় নুরু মিলিটারি, রওশন ও তাদের লোকজন আধিপত্য বিস্তার করেন। এর পরে তারা কাজী আরিফ আহম্মেদ হত্যাকাণ্ডের মিশনে অংশ নেয়। সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার কালিদাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে একটি সভা চলছিল। সভার সময় ব্রাশ ফায়ারে জাসদের পাঁচজন নেতা নিহত হন। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কাজী আরিফ আহমেদ ছাড়াও নিহত হন তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলা জাসদের সভাপতি লোকমান হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলী, স্থানীয় জাসদ নেতা ইসরাইল হোসেন এবং শমসের। হত্যাকাণ্ডের পর নুরু মেলেটারী গোপনে কুষ্টিয়ার কুমারখালী এলাকায় বসবাস শুরু করেন। কিছুদিন পরে কুষ্টিয়ার কুমারখালী এলাকায় সন্ত্রাসী দলের মধ্যে দন্দের কারণে নুরু মিলিটারি হত্যা শিকার হন।
এদিকে ওই হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পর ২০০৪ ইং সালের ৩০ অগাস্ট রওশন আলীসহ ১০ জনের ফাঁসি এবং ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন কুষ্টিয়া জেলা জজ।
তবে ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা হলে, ২০০৮ সালের ৫ আগস্ট হাইকোর্ট, ৯জনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন। একজনকে খালাস দেন ও ১২ জনের সাজা মওকুফ করেন। ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দুইজন এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে ২০১১ সালের ৭ আগস্ট হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেই আদেশ দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ১৯ নভেম্বর ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের রিভিউ আবেদনও খারিজ করে দেওয়া হয়। পরে তারা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইলেও তা নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।
২০১৬ সালের ৮ জানুয়ারী রাতে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি কার্যকর হয় ৩ আসামীর। এরা হলেন- কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার রাজনগর গ্রামের হাবিবুর রহমান, কুর্শা গ্রামের আনোয়ার হোসেন ও রাশেদুল ইসলাম। আসামিদের মধ্যে কারাগারে একজনের মৃত্যু হয় আর বাকীরা পলাতক রয়েছে। এর মধ্যে রওশন আলী আটকের মধ্য দিয়ে আরও একজন আটক হলো।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ